উনিশ শতকের ওয়াহাবি আন্দোলনের বন্দিদের একজন ছিলেন শের আলী, যিনি ১৮৭২ সালে পোর্ট ব্লেয়ারে ভাইসরয় লর্ড মেয়ো-কে ছুরির আঘাতে হত্যে করেন। ভাইপার দ্বীপে শের আলীর ফাঁসি হয়।
শের আলি আফ্রিদি বা শের আলি খান। যে শের আলি খানকে আমরা হয়তো অনেকেই চিনিনা
বা জানিনা বা ইতিহাসের পাতাতেও তেমন ভাবে খুঁজে পাইনা যেমনটা পাই অন্যান্য স্বাধীনতা
সংগ্রামী ভগৎ সিং বা খুদিরাম বসুর।
তবে আজ অতি সংক্ষিপ্তভাবে আমরা শের আলি খানকে জানব এবং স্মরণ করব।
শের আলি আফ্রিদি বা শের আলি খান খাইবার পাসের জামরুদ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ
করেন। খাইবার পাস বা খাইবার গিরিপথ হল একটি পার্বত্য গিরিপথ। যা স্পিন ঘার পর্বতের
উত্তরাংশকে ছেদ করে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানকে যুক্ত করেছে। তাঁর জন্মস্থান সম্পর্কে
জানা গেলেও তাঁর জন্ম সাল সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যাইনি।
তিনি ছিলেন ওয়াহাবী পাঠান ও শহীদ। পিতা ঊলি আলি খান। শের আলি খান ওয়াহাবী আন্দোলনের
সাথে যুক্ত ছিলেন। তবে এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী নানা মতামত রয়েছে।
শের আলি, শীর্ষস্থানীয় ওয়াহাবী নেতা মৌলানা জাফর থানেশ্বরী সহ আরোও অন্যান্য
বিপ্লবীদের ধরিয়ে দেওয়া তাছাড়াও পুলিশের গুপ্তচরবৃত্তির সন্দেহে হায়দার আলি নামক এক
যুবককে হত্যা করেছিলেন। তিনি ১৮৬৭ সালে পেশোয়ার (বর্তমান পাকিস্তান) থেকে ইংরেজ সরকার
কর্তৃক গ্রেপ্তার হন। সে বিচারে তাঁর মৃত্যদণ্ড হয়। তবে কোলকাতা হাইকোর্ট আলিপে তাঁকে
যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের দন্ড দেন। শের আলি খানকে রাখা হয় আন্দামানে। আন্দামানে তখনও
সেলুলার জেল তৈরি হইনি। সে সময়ে সেখানে দ্বীপে বন্দীদের কঠোর পাহারায় রাখা হতো। আন্দামানের
পোর্ট ব্লেয়ারের হোপ টাউন অঞ্চলের পানিঘাটায় বন্দি ছিলেন শের আলি।
৮ই ফেব্রুয়ারি ১৮৭২ সাল, বিকেলে লর্ড মেয়ো আন্দামানের হ্যেরিয়েট দ্বীপের সানসেট
পয়েন্টে সূর্যাস্ত দেখতে যান। বহুদিন ধরে শের আলি সুযোগ খুজছিলেন কী করে লর্ডকে হত্যা
করা যায়। সেদিন বিকেলে লর্ড দেহরক্ষী দ্বারা বেষ্টিত থাকা সত্বেও অতর্কিতে ছুরির আঘাতে
লর্ডকে হত্যা করেন শের আলি।
ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে শের আলি খান এমন একমাত্র
ব্যক্তি যিনি ভারতের ইংরেজ গভর্নর-জেনারেলকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর আগে খুদিরাম
বসুও চেষ্টা করে অসফল হয়েও ফাঁসির সাজায় শহীদ হন। কিন্তু দূর্ভাগ্যের কথা এই যে, ক্ষুদিরাম
বসুকে যেমনভাবে স্মরণ রাখা হয়েছে বা স্মরণ করা হয় তার বিন্দুমাত্রও শের আলি খানকে স্মরণ
করা হয়না, বরং ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার জন্য যা যা করার দরকার তা করা হয়।
শের আলি জানতেন, তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই বড়লাটকে হত্যা করাতা স্বয়ং ঈশ্বর
বা প্রভু দ্বারা নির্দেশিত। শুধু তাই নয়, তিনি দুজন সাহেবকেও হত্যা করতে চেয়েছিলেন,
একজন সুপারিন্ডেন্টন্ট ও অন্যজন বড়লাট। এই হত্যার জন্য তিনি সারা দিন অপেক্ষা করে ছিলেন
অতঃপর সুযোগ আসে সন্ধ্যার দিকে।
তবে চমকপ্রদ তথ্য হল উনি যে ছুরি দিয়ে লর্ডকে হত্যা করেন সে ছুরি তিনি তাঁর
খাবার থালা ভেঙে ছুরি তৈরি করছিলেন, যেন গার্ডরা সন্দেহ না করতে পারে।
তার এই হত্যা ব্রিটেন তথা ভারতের ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়।
লর্ড হত্যার দায়ে ইংরেজ সরকার শের আলি খানকে ফাঁসির সাজা দেয়। ১১ই মার্চ ১৮৭৩
সালে আন্দামানের ভাইপার দ্বীপে শের আলি খানের ফাঁসি হয়।
আসুন, আজ আমাদের ৭৪তম স্বাধীনতা দিবসে অন্যান্য সকল শহীদদের মতই স্মরণ করি শহীদ
আসফাকুল্লাহ্ ও শের আলি খানদেরও।
তথ্যসূত্রঃ
১। আনন্দবাজার
পত্রিকা সম্পাদক সমীপেষু ২৩শে মে ২০১৭।
২। ‘শের-ঈ-শহীদ
দ্বীপ’ – নারায়ন সান্যাল।
৩। ‘মুক্তির
সংগ্রামে ভারত’ – পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমি।
মতামত দিন