ভারতীয় হিন্দি সিনেমা জগতের অন্যতম ও অভিজ্ঞ নৃত্য পরিচালকদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় একটি নাম - সরোজ খান।
'মাস্টারজি' সরোজ খান
Author's Name: মোজাহিদুল ইসলাম
Credit: 0
সরোজ খান
জন্ম ও পরিচিতিঃ
১৯৪৮ সালের ২২শে নভেম্বর, বাণিজ্য নগরী মুম্বাই শহরে এক ক্ষত্রীয় শিখ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন সরোজ খান, পূর্ব নাম নির্মলা নাগপাল। তবে ভারতীয় নৃত্য জগতে তিনি সরোজ খান নামেই পরিচিত। পিতা কৃষ্ণচাঁদ এবং মাতা ননী সিং দেশ বিভাগের সময়ে মুম্বাইয়ে চলে আসেন।
বিবাহ ও কর্মজীবনঃ
বিখ্যাত ফিল্ম কোরিওগ্রাফার বি. সোহানলাল এর সঙ্গে কাজ করার সময়ে তাঁর কাছ থেকেই তিনি নাচ শেখেন এবং তাকেই নিজের গুরু হিসাবে গ্রহণ করেন। পরবর্তিতে মাত্র ১৩ বছর বয়সে কোরিওগ্রাফার বি. সোহানলালের সাথেই তিনি প্রণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। সে সময় বি. সোহানলাল সাহেবের বয়স ছিল ৪৩। কিন্তু তিনি ছিলেন বিবাহিত এবং ৪ সন্তানের বাবা এটা সে সময়ে সরোজ খান জানতে পারেন নি। পরবর্তিতে বি. সোহানলালের সাথে বিচ্ছেদের পর তিনি ১৯৭৫ সালে ব্যবসায়ী সরদার রোশন খানকে বিয়ে করেন।
মাত্র ৩ বছর বয়সে একজন শিশু শিল্পী হিসেবে ‘নাজ̣রানা’ ছবি দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। পরে ১৯৫০ এর শেষের দিকে একজন ব্যাকগ্রাউণ্ড ড্যান্সার হিসেবে সুযোগ পান। পরে তিনি একজন সহকারী কোরিওগ্রাফার রূপে কাজ শুরু করেন এবং ১৯৭৫ সালে ‘গীতা মেরা নাম’ ছবিতে একজন পরিপূর্ণ কোরিওগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
ভারতীয় নৃত্য পরিকল্পক জগতে আরো বেশি করে পরিচিতি পেতে তাঁকে বেশ অপেক্ষা করতে হয়। অবশেষে ১৯৮৭ সালে শ্রীদেবীর সঙ্গে ‘মিঃ ইণ্ডিয়া’ ছবিতে কাজ করে সফলতার প্রথম মুখ দেখেন। তারপর ‘মাস্টারজি’কে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক – ‘হাওয়া হাওয়াই’, ‘নাগিনা’ এবং ১৯৮৯ সালে ‘চাঁদনি’। তারপরে মাধুরী দিক্ষীতের সাথে ১৯৮৮ সালে ‘তেজাব’ -এর “এক দো তিন”, ১৯৯০ সালে ‘থানেদার’-এর “তাম্মা তাম্মা লোগে তাম্মা” এবং ১৯৯২ সালে ‘বেটা’ ছবির “ধাক ধাক কারনে লাগা” অসামান্য সফলতা লাভ করে। যার ফলে ধীরে ধীরে বলিউড জগতে তিনি একজন সফলতম কোরিওগ্রাফার হয়ে ওঠেন। পরবর্তিতে ‘গুলাব গ্যাং’ এবং ‘কালাঙ্ক’ ছবিতে সরোজ খান আবার মাধুরী দিক্ষীতের সাথে কাজ করেন।
‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’, ‘ডর’, ‘বাজিগর’, ‘স্বদেশ’, ‘পারদেশ’, ‘দেবদাস’, ‘ডন’, ‘বীর-যারা’, ‘আনজান’, ‘মোহরা’, ‘বেটা’, ‘তেজাব’, ‘সোলজার’, ‘আওর পেয়ার হো গায়া’, ‘আয়না’, ‘তাল’, ‘ফিযা’, ‘সাঁথীয়া’, ‘কুছ না কাহো’, ‘লাভ আজ কাল’, ‘জাব উই মিট’, ‘লাইফ পার্টনার’, ‘তানু ওয়েড্স মানু রিটার্ন্স’, ‘লাগান’, ‘ফানা’, ‘মানিকার্নিকা’, ‘শ্রিঙ্গারাম’, ‘হাম দিল দে চুকে সানাম’, ‘গুরু’, ‘নামাস্তে লন্ডন’, ‘সাওয়ারীয়া’, ‘গুলাব গ্যাং’, ‘কালাঙ্ক’ -এর মতো আরোও অনেক ছবির নাচের উজ্জ্বল দৃশ্য তারই অবদান। চল্লিশ বছরের কর্মজীবনে তিনি ২০০০-এরও বেশি গানের নৃত্য পরিচালনা করেন। তাঁর অনন্য সব নাচের স্টেপগুলো আজও বলিউড ও সাধারণ মানুষের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়। তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এমন একটা সময় ছিল যখন নায়িকারা তাঁর ছাড়া আর অন্য তেমন কোন কোরিওগ্রাফারের সঙ্গে কাজ করতে রাজি হতেন না।
টিভি শো’
সিনেমা জগতের নৃত্য পরিচালনা ছাড়াও তিনি টিভির পর্দাতেও অনেক জনপ্রিয় ছিলেন। বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলের নাচের শো’তেও তিনি একজন বিচারক এবং সহকারী বিচারক রূপেও কাজ করেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
২০০৫ সালে স্টার ওয়ান চ্যানেল দ্বারা পরিচালিত “নাচ বালিয়ে”
সোনি এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেল দ্বারা পরিচালিত “উস্তাদোঁ কা উস্তাদ” এবং “ঝালাক দিখলা জা” শো’এর তৃতীয় পর্ব।
২০০৮ সালে এনডিটিভি ইমাজিন চ্যানেল দ্বারা পরিচালিত “নাচলে ভে উইথ সরোজ” এটি ছিল একটি ডান্স ক্লাব শো’।
২০০৮ সালেই সোনি চ্যানেল দ্বারা পরিচালিত “বুগি উগী” শো’তেও তিনি উপস্থিত ছিলেন।
মৃত্যুঃ-
তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন অতঃপর ১৭ই জুন ২০২০ সালে শ্বাসকষ্ট প্রবল হলে তাঁকে মুম্বাইয়ের বান্দ্রার গুরু নানক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সম্প্রতি তার করোনা পরীক্ষাও করা হয়েছিল, তবে রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআই -এর রিপোর্ট অনুযায়ী ৩রা জুলাই শুক্রবার ভোররাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৭১ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তী সরোজ খান।
পুরস্কারঃ-
জাতীয় পুরস্কারঃ-
তিনি তাঁর অনবদ্য কৃতিত্বের জন্য ভারতে এবং ভারতের বাইরেও পুরস্কৃত হন। তিনি তিনবার বেস্ট কোরিওগ্রাফির জন্য জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। প্রথমবার ২০০৩ সালে ‘দেবদাস’ ছবির “ডোলা রে ডোলা” গান-এর জন্য। দ্বিতীয়বার ২০০৬ সালে ‘শ্রীঙ্গারাম’ ছবির সমস্ত গানের কোরিওগ্রাফির জন্য। এবং ২০০৮ সালে ‘জাব উই মিট’ ছবির “ইয়ে ইশক্ব হায়ে…” গানের জন্য জাতীয় পুরস্কার পান।
ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডঃ-
সরোজ খানই হিন্দি সিনেমা জগতের প্রথম কোরিওগ্রাফার যিনি সর্বপ্রথম বেস্ট কোরিওগ্রাফির জন্য ‘ফিল্ম ফেয়ার’ পুরস্কার পান। তিনি ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত পরস্পর তিন বার ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেন। এমনকি তিনিই একমাত্র নৃত্য পরিচালিকা যিনি সর্বোত্তম ৮ বার ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
আমেরিকান কোরিওগ্রাফি অ্যাওয়ার্ডঃ-
২০০২ সালে ‘লাগানঃ ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন ইন্ডিয়া’ -এর জন্য “আমেরিকান কোরিওগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড’ পান।
নন্দী অ্যাওয়ার্ডঃ-
১৯৯৮ সালে ‘চুড়ানওয়ালি ভুন্ডি’-র বেস্ট কোরিওগ্রাফারের অ্যাওয়ার্ড পান।
কালাকার অ্যাওয়ার্ডঃ-
নৃত্য পরিচালনায় অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ২০১১ সালে ১৯তম ‘কালাকার অ্যাচিভ অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করেন।।
মতামত দিন