
রাতপাখি
কলমেঃ কথাকলি
গল্পঃ রাতপাখি
------------------------------------------------------
প্রতিদিন দুপুরে হাল্কা রোদের আদর মেখে শব্দগুলো সেজেগুজে হাজির হয় নতুন পোষাকে নতুন গল্পের চরিত্র হয়ে। ঘরের বাইরে জানলা চুঁয়ে তখন এক ঝলক মিঠে রোদ্দুরের উঁকি ঝুঁকি। বছর ঘুরে আরও একটা বৈশাখের তপ্ত দুপুর। নির্জন ঘরে সিলিং ফ্যানের একঘেঁয়ে শব্দ। জানালার ওপারে নিমগাছের ডালে ডালে তখন শালিক আর ছাতার পাখির কিচিরমিচির। দক্ষিণে জানালার একপাশে লেখার যাবতীয় সরঞ্জাম সমেত বেশ বড়সড় একটা কাঠের টেবিল, চেয়ার সমেত। ঘড়িতে সময় দুপুর তিনটে। এইসময়টা ঠিক দুপুর না বিকেল বলা মুশকিল। ঘরের ঠান্ডা মেঝেতে ঘুমিয়ে পোষা কুকুর পান্না। খাটের পাশে ছোট্ট টুলে একটা জলের জগ আর স্টিলের গ্লাস। খাটের ওপর টানটান পরপাটি বিছানা। ফুলছাপ বালিশের তলায় সুন্দর কমলা-সবুজ চাদর। দেওয়ালের দিকে সাজানো বালিশের পাশে কয়েকটি গল্পের বই। সেখানে আছে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘হাল্কা হাসি চোখের জল’, ‘শরদিন্দু অমনিবাস’, হুমায়ুন আহমেদ এর ছোটো গল্প সংকলন, বনফুলের ছোটো গল্পসমগ্র। ঘড়ির কাঁটা টিক্ টিক্ শব্দে সময়ের জানান দিচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। দূরে খেলার মাঠ থেকে ভেসে আসছে বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড়। জানালার সামনে নিমগাছ আর জামগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে তাকালে দেখা যাবে মাঠের সেই দৃশ্য। রোজকার অভ্যস্ত জীবনের পর্দা সরে যাচ্ছে এক এক করে। এরইমাঝে ঘরের মধ্যে হঠাৎ করে থেমে গেলো ফ্যানের ব্লেড, সাথে ঘর্ ঘর্ শব্দটা। সাথে সাথে অদ্ভুত নিস্তব্ধতার চাদরে ঢাকা পড়ে গেলো চারিদিক। থেমে যাওয়া ফ্যানের পাখায় দেখা গেলো ছোপ ছোপ ঝুলকালি। শেষ বিকেলের অন্যান্য শব্দগুলো নির্জন দুপুরের ফিকে রোদে আবছা সবুজ গাছের পাতায় পাতায় ভেসে বেড়াতে লাগলো। ফুরফুরে হাওয়ায় উড়তে থাকে টেবিলের ওপর রাখা বইয়ের পাতা। নীচেয় ঘরের মেঝে থেকে মাথা তুলে পান্না উৎসুক হয়ে চেয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করে। তার এতো সুন্দর দিবানিদ্রার ব্যাঘাত ঘটায় সে একটু হতবাক। অন্যদিকে এতোসবের মধ্যেও অত্যন্ত মনযোগী হয়ে বাকি লেখাটা শেষ করতে ব্যাস্ত নিশানাথ বক্সী। ভৌতিক গল্প লিখে খুব অল্প সময়ের মধ্যে পাঠকমহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। বয়স প্রায় ষাটোর্ধ। বেশ টানটান সুগঠিত শরীরের গড়ন। দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই। একসময় প্রচুর দৈহিক পরিশ্রম করতেন। দীর্ঘদিন অভাব অনটনে কেটেছে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে শহুরে জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে সময় লেগেছে প্রায় দশ বছর। তখন উনি নিতান্তই কিশোর। এমনকি বেশকিছুদিন শহরের বিভিন্ন প্রান্তে নানাধরণের অপ্রত্যাশিত কাজও করেছেন। তারমধ্যে আছে হোটেলের বাসনমাজার কাজ। উনার অতীত জীবনের সেইসব বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতার চিত্রবিচিত্র স্মৃতিবিজড়িত রূপ-রস-বর্ণ এখন গল্পের পাতায় নানান ঘটনা সম্বলিত গল্পের বিষয় হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে।
গল্পটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ হলো না। সন্ধ্যে সাতটা। বাইরের দিকের অন্ধকারে গাছের ডালে ডালে ঝিকিমিকি জোনাকির আলো। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলো আজ আর জ্বলছে না। সেই দুপুর থেকেই পাওয়ার কাট্। অন্যান্য দিনের মতো প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে না বিভিন্নধরনের বাংলা সিরিয়ালের জোরালো সংলাপ। সারা পাড়া ভীষণ রকম চুপচাপ। নিশানাথের শোবার ঘরের বিছানার উল্টোদিকে জানলার বাইরে নিমগাছের পাতা হাল্কা হাওয়ায় কাঁপছে ঝিরিঝিরি। অনেকদূরে মাঠের মধ্যে কারা যেনো বসে উঁচু গলায় কথা বলছে। ঘরের মধ্যে ভ্যাপ্সা গরমে অস্থির হয়ে আশেপাশের মানুষজন এসে বসেছে মাঠের খোলা হাওয়ায়। সেই দুপুর থেকে কারেন্ট নেই। শীতলা মন্দিরের সামনে ট্রান্সফরমার বার্স্ট করেছে। আজকের মতো আর আলো জ্বলবে না এ চত্ত্বরে। নিশানাথ রাতের খাবার খেয়ে পশ্চিমের বারান্দায় গিয়ে একটা বিড়ি ধরালো। মাথাটা ঝিম্ ধরে আছে। অনেক্ষণ ধরে হ্যারিকেনের আলোয় লিখেছে আজ। তবু গল্পটা শেষ করতে পারলো না। ওর এই একাকী জীবনের অবসর সময়, একের পর এক অজানা রহস্যময় সব বিচিত্র গল্পের বিশিষ্ট চরিত্রসম্বলিত ঘটনাবলী সাজাতে সাজাতেই কেটে যায়।
সেদিনটা মনে হয় সপ্তাহের শেষ শনিবার ছিলো। দোতলার বারান্দার অন্ধকারে নিশানাথ তখন বিড়িতে একমনে সুখটান দিচ্ছে। এমনসময় টের পেলো পাশে কে একজন দাঁড়িয়ে। অবিকল ওর মতো ভঙ্গিতে হাতে বিড়ি নিয়ে। হাল্কা অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে না। গায়ে সাদা হাতকাটা গেঞ্জি, তার নিচে লুঙ্গি। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে তাই সাদা গেঞ্জি বেশ ভালো বোঝা যাচ্ছে।
- “কি মশাই নতুন কিছু লিখলেন নাকি? অবশ্য নতুন কেনো বলছি, সেই তো একই বস্তাপচা সব ভূতের গল্প।”
নিশানাথ সচকিত হয়ে পাশে তাকিয়ে উত্তর দিতে ভুলে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ পর বলে উঠলো
- “আপনি পড়ে দেখেছেন তাহলে।”
- “কি যে বলেন, পড়বো না! সারাক্ষণ তো ওইসব গল্পের বিষয় নিয়েই আছি। বড্ড বিরক্তিকর। কিন্তু কিছুই করার নেই, এটাই আমার একমাত্র কাজ।”
- “কেনো, কি কারণে এতো বিরক্তি? আরে তার আগে আপনার পরিচয় তো বলুন। আর এই অসময়ে আপনি কিভাবে এখানে এলেন?”
- “সেসব পরে বলছি, আগে বলি মশাই এবার আপনি একটু নতুন কিছু ভাবুন। আপনার লেখা ভালো, কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই ধরনের হয়ে যায় সব লেখা। কিছু নতুন মশলা দিন এবার গল্পে।”
- “আসলে আগে কখনো কেউ আমাকে এভাবে বলেনি। এবার থেকে সতর্ক হবো লেখার সময়।”
- “জানি আপনি সারাদিন একা থাকেন তাই গল্পের বিশেষ কিছু ঘটনার বর্ণনা অনেকসময় মিলে যায়, সেটাও ঠিক নয়।”
- “ঠিক আছে এরপর থেকে মনে রাখবো আপনার কথা। এবার অনেক রাত হলো শুয়ে পড়বো। আপনার পরিচয় এবং গতিবিধি কিন্তু অজানাই থেকে গেলো।”
কথাটা বলে পাশে তাকাতেই হাল্কা অন্ধকারে কাউকেই দেখতে পেলো না নিশানাথ। বারান্দার দঁড়িতে শুকনো গামছাটা টেনে তুলে নিলো এক হাতে। নিচে গলির মুখে চায়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে। অমলের পানের দোকানে হ্যাজাকের আলোয় অমলের ছেলে পান সাজাচ্ছে। ওদের দোকান অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। আশেপাশের অনেক মদোমাতাল পান বিড়ি নেয় অনেক রাত পর্যন্ত ওদের দোকান থেকে। নিশানাথ কাল ওদের দোকান থেকে দু প্যাকেট বিড়ি নিয়েছে। নিচে রাস্তার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মাথায় এলো এতোক্ষণ যার সাথে কথা বলছিলো সে লোকটা কে? গেলো কোথায়? হয়তো মনের কল্পনা। অতিরিক্ত লেখালেখির জন্য এসব দেখছে। ভাবতে ভাবতে নিশানাথ বিছানায় শুতে গেলো।
রাত গভীর। ঘোলাটে আকাশে একফালি ভাঙা চাঁদ। অনেকদূরে স্থির আকাশে কয়েকটা মিটমিটে তারা। খোলা জানলা দিয়ে অল্প অল্প বাতাস আসছে ঘরের মধ্যে। রাতের ঠান্ডা আমেজে দুপুরের উত্তাপ ঝিমিয়ে পড়েছে। আজ আর মশারি টাঙানো নেই বিছানায়। রোজকার মতো খাটের নীচে শুয়ে আছে পান্না। জানলার কাছে টেবিলের নীচে নিবু নিবু আলোয় জ্বলছে একটা হ্যারিকেন। কিছুক্ষণ আগেও পান্না খুব বিচ্ছিরিভাবে চাপা স্বরে ডাকছিলো, যেটা শুনে মনের অজান্তেই বুঝি অশুভ কিছুর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এদিকে সারাদিনের ক্লান্তির পর নিশানাথ অঘোরে ঘুমাচ্ছে নিজের বিছানায়। এরই মাঝে গভীর রাতে ঘরের মধ্যে হ্যারিকেনের আলো আঁধারীতে তাকালে দেখা যাবে বিছানার পায়ের দিকে জানলার কাছে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে কেউ একজন বসে। তার সামনে খুলে রাখা নিশানাথ বক্সীর অসমাপ্ত গল্পের খাতা। চেয়ারে বসে অদ্ভুত ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকে কলম হাতে নিয়ে কি যেনো লিখে চলেছে খস্ খস্ শব্দে খাতার পাতায়। কিন্তু এরকম অন্ধকারে তো কোনো মানুষের পক্ষে এভাবে খাতায় কিছু লেখা সম্ভব নয়। নাহ্ গল্পটা শেষ করতেই হবে যেভাবেই হোক। অভ্যস্ত হাতে ধীরে ধীরে শেষ হচ্ছে একটা গল্পের পটভূমি। হয়তো এভাবে সকলের অগোচরে রাতের নিঝুম অন্ধকারে আগেও শেষ হয়েছে কিছু চেনা গল্পের অচেনা অলৌকিক বিবৃতি। সময়ের হাত ধরে পিছিয়ে গেলে সন্ধান পাওয়া যাবে এই ঘরেরই এই টেবিল চেয়ারকে সাক্ষী রেখে ঘটে যাওয়া এইরকম কিছু অদ্ভুত অতিপ্রাকৃত ঘটনার। বাড়ির পোষ্য কুকুর পান্না প্রায়ই দেখে অনেক রাতে তার মনিব নিশানাথ ঘুমিয়ে পড়ার পর মায়াবী রাতের আবছা আলো-আঁধারি আলোয় নিশাচর এক লেখকের অভ্যস্ত হাতে উঠে আসে সেই দোয়াত-কলম আর তারই ছোঁয়ায় সাদা খাতার পাতায় খস্ খস্ শব্দে শেষ হতে থাকে এক একটি গল্পের পরিপূর্ণ রূপান্তর। পরেরদিন সকালে নিশানাথের কিন্তু একবারের জন্যও মনে সংশয় দেখা দেয় না সেই অসমাপ্ত গল্পের পরিপাটি সুন্দর বিবরণযুক্ত পরিসমাপ্তি নিয়ে। মনের অবচেতনে হয়তো জানা হয়ে থাকে রাতের অন্ধকারে ঘটে যাওয়া কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনার পুঙ্খাণুপুঙ্খ বিবরণ।।
মতামত দিন