
প্রভাত
গল্পকারঃ ডাঃ আম্বার আবিদ
অনুবাদকঃ মোজাহিদুল ইসলাম
প্রভাত
----------
রামলা দ্রুততার সঙ্গে তৈরি হয়ে নিচ্ছিল। প্রতিবারের মতো আজও তার দেরি হয়ে গেছে। পাঁচটার সময় আতিফ এর সঙ্গে দেখা করার কথা ঠিক হয়েছিল কিন্তু অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই তাঁর সোয়া পাঁচটা। যতক্ষণে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে এসে ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়ে থাকা ঘড়িটির উপর দৃষ্টি পড়ল ততক্ষণে সময় সাড়ে পাঁচটা। তাড়াতাড়ি করে এলোমেলো চুলের উপর দু-একবার চিরুনি চালিয়ে দ্রুত গাড়ির চাবি নিয়ে দৌড়ে নীচে নামল। আজ আবার আতিফের অভিমান এর কথা ভেবে তাঁর মন কেমন করছিল।
“মা আমি যাচ্ছি……” বলতে বলতে সে মূল ফটকের দিকে প্রায় দৌড়ে গেল। ভাগ্যিস বাড়ি ফিরেই মা’কে বলেছিল যে, আজ সে একটু বাইরে বেরোবে, নয়তো এতক্ষণ মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সময় যেত।
আতিফ তাঁর বাগদত্তা সঙ্গে মাসতুতোও। প্রায় চার বছর ধরে তারা দুজনে এই (আশির্বাদীর) পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ। তাঁদের দু’জনের পছন্দে তাঁদের পরিবারেরও সন্তুষ্টি ছিল। দিন যত এগোচ্ছিল দুই পরিবারের পক্ষ থেকেই বিয়ের চাপ তত বাড়ছিল। কিন্তু রামলা এখনও বিয়ের ঝামেলায় জড়াতে চাইছিলনা, কেন না শহরের সব থেকে বড় টেক্সটাইল ইন্সটিটিউটে ‘টেক্সটাইল ডিজাইনার’ রূপে তাঁর নিয়োগ হয়েছিল। রামলা তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলোকে বাস্তব রূপ দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। সে চাইছিল জীবনে অনেক উন্নতি করতে, কিন্তু…… তাঁর স্বপ্ন পূরণের পথে বাঁধা হয়ে দাড়াচ্ছিল বিয়ে। তাই সে বেড়ে ওঠা বিয়ের জিদ’কে পেছনে ফেলে দিতে চেয়েছিল।
মানুষ হিসেবে আতিফ ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও সহজ-সরল প্রকৃতির। ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং হওয়ার পাশাপাশি সে দূরদর্শীও ছিল। সে কখনো রামলার উন্নতির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে চায়নি। তাই সে তাঁর পরিবারকে বুঝিয়ে নিজে রামলার উন্নতিতে পাশে থাকার ওয়াদা করেছিল।
মুম্বাই এর জন-সমাগম, ট্রাফিক ও গতিকে পাশ কাটাতে কাটাতে রামলা যতক্ষণে বান্দ্রা বেন্ড স্ট্যান্ড-এ পৌঁছল ততক্ষণে ঘড়ি সাড়ে ছ’টা।
সমুদ্রতীর হতে কিছুটা দূরে এক উঁচু পাথরের উপরে আতিফ চুপচাপ আর কিছুটা আনমনা হয়ে বসে। রামলা প্রায় দৌড়ে এসে পাশে দাঁড়িয়ে কম্পিত স্বরে বলল – “আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়া আলাইকুম আসসালাম” আতিফ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সালাম এর উত্তর দিল।
“আসলে আতিফ……… অফিসে শেষ মুহুর্তে কিছু মক্কেল চলে আসে……… তাঁর উপর ট্রাফিক এত বেশি ছিল যে…… আমি……… Sorry!”
এদিকে আতিফ চুপচাপ তাঁর দিকে তাকিয়েই রয়েছে।
“আচ্ছা ঠিক আছে!”
রামলা মনে মনে লজ্জিত হচ্ছিল।
“প্লিজ আতিফ কিছু মনে করো না…… পরের বার থেকে অবশ্যই খেয়াল রাখব।
“হুম” তাঁর কপালে ছিল চিন্তার ভাঁজ আর চেহারায় ছিল ভালোবাসা মিশ্রিত সম্মান।
সময়ের আনন্দ মিশ্রিত করে আর নিজ দুঃখ প্রকাশকে কিছু সীমা পর্যন্ত লুকিয়ে রামলা বলল – “আচ্ছা বলো প্ল্যান কী?”
কোনো কিছু না বলে আতিফ উঠে দাঁড়ালো।
সে জানতো অফিস থেকে ফিরে রামলা এখনও কিছু খায়নি। দু’জনে মন্থর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে রেস্তোঁরায় প্রবেশ করল। আতিফ ওয়েটার ডেকে চিপ্স, স্যান্ডউইচ আর কফির অর্ডার দিল। এখানকার চিপ্স, স্যান্ডউইচ রামলার পছন্দ সেটা আতিফ এর জানা ছিল।
স্যান্ডউইচ ও গরম কফির দৌলতে রামলার শরীর যেন প্রাণ ফিরে পেল। রামলা খেয়েই চলেছে আর এদিকে আতিফ নিস্পলক দৃষ্টিতে রামলার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিছু খেয়ে রামলা যখন সতেজতা অনুভব করল তখন সে আবার লজ্জিতবোধ করল।
“সরি আতিফ! আজ আবার দেরি হয়ে গেল।”
“এটা নতুন কি? আচ্ছা তুমি জানো তুমি কতটা বদলে গিয়েছ? না আগের মত স্বাস্থ্য আর না রূপ-সৌন্দর্য্য ও ঔজ্জ্বলতা…… সেই আগের হাসি-খুশি, চঞ্চলা রামলা যেন কাজ-কর্মের রোষানলে কোথাও চাপা পড়ে রয়ে গেছে। রামলা, আগে জীবন তারপর কাজ, আগে কাজ তারপর জীবন নয়।
রামলা নিশ্চুপ হয়ে আতিফের কথা শুনে যাচ্ছিল। কারণ আতিফ যা কিছুই বলছিল একদম ঠিক বলছিল। আর তাঁর কথায় রামলার প্রতি যত্ন, ভালোবাসা ও টান ছিল।
দেখো রামলা! আজ কয়েকদিন ধরে মায়ের শারিরীক অবস্থা খুব একটা ভালো না। তাঁর বড় শখ আমাকে বিয়ের সাজে দেখার। আমার দুই বোন তারা আল্লাহর দোয়ায় সুখের সংসার করছে। কিন্তু তবু মা আমার বিয়ের স্বপ্ন দেখছে।
“আতিফ আমি জানি……… কিন্তু আমার চাকরি………”
“সে ঠিক আছে, বিয়ের পরেও তো তুমি………”
“না……… না আতিফ না, বিয়ের পরে অন্যান্য দায়-দায়িত্ব এবং আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এত সব কিছু কীভাবে সামলাবো আতিফ? তাছাড়া তুমি তো জানো যে, কাজের উদ্দেশ্যে প্রায় প্রত্যেক মাসে আমাকে কম করে হলেও দু’বার শহরের বাইরে যেতে হয়। এত সব কি করে ম্যানেজ করব বলো?
নির্বাক চোখে আতিফ রামলার দিয়ে তাকিয়ে ছিল।
আতিফ অত্যন্ত ভদ্রতার সঙ্গে রামলার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে আলতো করে ভালোবাসার সঙ্গে চেপে ধরে বলল-
“রামলা, আমার কোনো তাড়া নেই…… তুমি তো জানোই……… কিন্তু আমার বাড়ির লোকজন…………”
মৃদু হেসে রামলা বলল – “যাই হোক; এবার কী প্রোগ্রাম?”
“চলো সিনেমা দেখি।”
অতঃপর দুজনে উঠে গাড়ির দিকে যেতে শুরু করল।
এভাবে আরো দু’মাস কেটে গেল। কাজের উদ্দেশ্যে রামলার ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার কথা ছিল, তাই সে এখন সেখানে। যাওয়ার পূর্বে সে আতিফকে কথা দিয়েছে যে, সে খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে।
ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে এসেই রামলা একটি বড় প্রজেক্টের অফার পেয়েছে এবং সেই প্রজেক্টে সে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাত-দিন শুধু কাজ করে করে সে কাজের প্রতি এতটাই মনোযোগী হয়ে গিয়েছিল যে, না তাঁর সময় মতো খাওয়ার খেয়াল থাকত আর না নিজের স্বাস্থ্যের পরোয়া। তাঁর মা তাকে হাজার বোঝালেও সেই বা শুনত কোথায়! মাথার উপর না ছিল বাবার ছত্রছায়া আর না ছিল কোনো ভাই-বোন। জীবনযুদ্ধে একাই লড়ে যাওয়ার আর জীবনের প্রতিটি যুদ্ধ যেন একাই জেতার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিল। অতঃপর সে অনেক সফলতা অর্জন করতে থাকে।
এদিকে হঠাৎ আতিফ এর মা হার্ট অ্যার্টাক-এ আক্রান্ত হয়ে হোসপিটালাইজড হয়ে পড়েন। মায়ের শারিরীক অবস্থার অবনতি দেখে আতিফ পাগল প্রায় হয়ে ওঠে।
পরিস্থিতির উত্তপ্ত মরুভূমিতে যে মা বর্ষার পানির মতো বর্ষণ করত, কঠিন সময়ে যে মা পাশে থেকে সান্ত্বনা দিত, যে মায়ের দুয়া তাঁর চোখের শীতলতা, আজ সে মা I.C.U -এর বেড এ শুয়ে।
আতিফ মায়ের শিয়রে মায়ের হাত ধরে বসে রয়েছে আর অশ্রু তার গাল বেয়ে গলাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। তার ঠোঁট কাঁপছে, কম্পিত ঠোঁটে শুধু উচ্চারিত হচ্ছে, ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরাহ’।
আল্লাহ আতিফ এর দুয়া কবুল করল। ছেলের মনের গভীরতা থেকে বেরিয়ে আসা ‘আহ’ যেন মায়ের স্তব্ধ অন্তর ছুঁয়ে মৃদু স্পন্দিত হলো।
আতিফ নিস্পলকভাবে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের ঠোঁট হালকা নড়ছে…… কিছু বলছে…… কিন্তু অস্পষ্ট ও টুকরো টুকরো শব্দ বেরিয়ে এলো……
“আমার জান……… বাবা আমার………”
“মা চোখ খোলো প্লিজ” – আতিফ মা’কে আওয়াজ দিল
সন্তানের ডাকে সাড়া দিয়ে মা ধীরে ধীরে চোখ খুলল – শুষ্ক ঠোঁটে বলে উঠল –
“আতিফ…… কলিজার টুকরো আমার……।”
মা তাঁর কোমল হাত দিয়ে সজোরে আতিফের হাত ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করল…
“মা…!” অশ্রু আতিফের গাল বেয়ে গলা পর্যন্ত ঝরে পড়ছিল।
“আতিফ…… বাবা আমার, আমি কি তোমার সুখময় জীবন…… তোমার সন্তান-সন্ততির স্বপ্ন চোখে নিয়েই কী পৃথিবী থেকে চলে যাব?”
“আল্লাহ না করুক…… মা তুমি এমন বলছ কেন?”
“বাবা…… আর কত দিন……?”
“খুব শিঘ্রই। দুআ করি তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো।”
এরই মাঝে ডাক্তার এসে আতিফকে বাইরে যাওয়ার অনুরোধ করলেন।
আজ যেন আতিফ একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।
সঠিক চিকিৎসা ও আতিফের দুআয় তাঁর মা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। আতিফ-এর মা অসুস্থ থাকাকালীন রামলা ও তাঁর মা দেখা করে আসত, কিন্তু প্রতিবারই রামলা আতিফের চলা-ফেরার অঙ্গি-ভঙ্গি ও কথাবার্তায় কিছুটা পরিবর্তন অনুভব করলেও পুরোপুরি কিছু বুঝে উঠতে পারে নি।
এদিকে রামলার প্রজেক্টের কাজ দ্রুত বেড়ে চলেছিল। কখনও এই ডিজাইন তো কখনও সেই গ্রাফিক্স আর বিভিন্ন স্কেচে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। এমতবস্থায় একদিন আতিফের ফোন এলো। দুর্ভাগ্যবশত রামলা সে সময়ে মিটিং-এ। আতিফ বেশ কয়েকবার ফোন করার চেষ্টা করলেও সেদিক থেকে ফোন এর কোনো উত্তর এলো না।
মিটিং শেষে রামলা আতিফ এর বেশ কয়েকটি মিসড্ কল দেখে ফোন করল।
আতিফ ফোন রিসিভ করায় রামলা ক্লান্ত স্বরে বলল –
“হ্যালো! আতিফ কেমন আছো? সরি আমি মিটিং-এ ছিলাম তাই কল রিসিভ করতে পারিনি…… আর……!!
“রামলা আমরা কবে দেখা করতে পারি?”
আতিফ-এর গলায় কিছুটা হলেও পরিস্কার কঠোরতার ভাব প্রকাশ পাচ্ছিল।
“ওহ……! দেখো আতিফ আমি তো এখন খুবই ব্যস্ত! তবুও……… কোনো বিশেষ কাজ ছিল কী?”
“হুম! একটি জরুরী কাজ……… আজ সন্ধ্যে পাঁচটায় সমুদ্রতীরে এসো” – আতিফ গম্ভীর গলায় বলল।
“ওকে!” – রামলা ক্লান্ত স্বরে বলল। তারপর ফোন সংযোগ ছিন্ন হয়ে গেল।
প্রতিবারের ন্যায় আজও রামলা অনেক কষ্টে সময় বের করে আতিফ এর সঙ্গে দেখা করতে গেল।
“কেমন আছো……? তোমাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে!”
“আছি…… প্রচুর কাজ। জানো তো একটা নতুন প্রজেক্ট পেয়েছি। সাহারা ইনিস্টিটিউট এর গ্র্যাণ্ড ফ্যাশন শো হতে চলেছে আর সেই শো-এর ড্রেস ডিজাইনার হিসেবে আমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে।”
রামলা বেশ আগ্রহের সঙ্গে বলে চলেছিল আর আতিফ অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে শুনছিল।
“আর আতিফ জানো তো আমি সমস্ত গ্রাফিক্স তৈরি করে নিয়েছি, সমস্ত ডিজাইন ও স্কেচও। তুমি কবে দেখতে আসছো………?”
তাড়াহুড়োর মাঝে রামলা আতিফের মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করতেই ভুলে গিয়েছিল। আতিফ দেখছিল যে রামলার চেহারায় যে রঙ আসছে আর যাচ্ছে সেই রঙ-এ সফলতা ও ভবিষ্যতের রশ্মি যেন নিস্প্রভ। সে শুধু অনর্গল বলেই চলেছিল।
“রামলা…… রামলা আমার কথা শোনো……” সে থমকে গিয়ে একদম নিশ্চুপ হয়ে আতিফের দিকে নিস্পলক ভাবে স্থির হয়ে রইল। যেন হঠাৎ করে কেউ এসে সোনালী স্বপ্নের কোল থেকে টেনে-হিঁচড়ে জাগিয়ে তুলল।
“রামলা আমি যা কিছু বলতে যাচ্ছি দয়া করে কখনোও সে কথা গুলোর ভুল অর্থ বের করো না। আমি তোমার সফলতার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। আমি জানি তোমার এখনও অনেক কিছু করার বাকি, তোমাকে আরোও অনেক এগিয়ে যেতে হবে জানি…… কিন্তু এখন…… এখন আমি আর আমার মাকে বোঝাতে পারছিনা।”
কথা গুলো বলতে বলতে আতিফের গলা ভারী হয়ে এলো।
“আরে হ্যাঁ, খালাম্মার শরীরের অবস্থা কেমন এখন?”
“কিছুটা ভালো…… কিন্তু আমার বিয়ে নিয়ে বেশ চিন্তিত। দিন এর পর দিন মায়ের জিদ বেড়েই চলেছে…… উপরন্ত শরিরীও মায়ের সঙ্গ দিচ্ছেনা।”
“কিন্তু আতিফ তুমি তো ভালো করেই জানো যে………”
“হ্যাঁ রামলা আমি জানিও আর বুঝিও…… তাই তো বলছি তুমি একবার ভালো ভাবে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো। জীবন অত্যন্ত গতিশীল রামলা, সময় কাউরি জন্য থেমে থাকেনা অথচ জীবন সামনের দিয়ে এগিয়ে যায়। আর সাতাশ বছর বয়স কোনো মেয়ের বিয়ের জন্য কম নয়। তাছাড়া এখনও জীবনের অন্যান্য অনেক ধাপ বাকি যেগুলো জীবনযাত্রায় পার করতে হবে। তুমি বুদ্ধিমতী বাকিটা তুমি নিজে ঠিক বুঝে নাও। কিন্তু আপাতত এই মুহুর্তে এ বিষয়ে আমি বড় অসহায় রামলা!”
আতিফ একটু থেমে নিঃশ্বাস নিয়ে ভারাক্রান্ত স্বরে অত্যন্ত নম্রতার সঙ্গে রামলাকে বুঝিয়ে বলল –
“রামলা…… তুমি সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে ভালোভাবে বুঝে আমাকে উত্তর দেবে। আমি তোমার প্রতি কোনো ধরণের চাপ সৃষ্টি করতে চাই না। আমার পরিস্থিতি ও আমার অসহায়তাকে বোঝার চেষ্টা করো। তুমি নিজের জায়গায় একদম সঠিক আর তোমার নিজের জীবনের প্রতি তোমার নিজস্ব ইচ্ছে ও অধিকারও আছে। আমি তোমার সফলতা ও উন্নতির পথে বাঁধা হতে চাইনা…… তাই………”
“তাই কী……? তাই কী আতিফ………?” – রামলা যেন থতমত খেয়ে উঠল।”
“তাই ভালো এটাই হবে যে আমরা আমাদের পথ আলাদা করে নি।”
আচমকা যেন রামলাকে কেউ এক ধাক্কায় পেছনের দিকে ঠেলে দিল।
কত সহজেই না আতিফ কত বড় একটা কথা বলে দিল। তারা কখনও আলাদা হতে পারে ভুলেও এমনটা ভাবেনি। আতিফের স্বত্তাই যেন রামলার সব থেকে বড় আশ্রয়স্থল ছিল। স্মার্ট ও হ্যাণ্ডসম হওয়ার পাশাপাশি সে ছিল এক বুদ্ধিমান ও সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ। অথচ রামলা ছিল চঞ্চলা। তাঁর সমস্তরকম ছেলেমানুষিকে আতিফ হাসিমুখে মেনে নিত, যেমন কেউ নিস্পাপ ছোট্ট শিশুকে দেখে করে থাকে। আতিফের কথা শুনে তাঁর চোখে অশ্রু টগবগ করছিল। কিন্তু সে বুকে পাথর বেধে নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ দুটো ঘষে নিল। কেননা সে আতিফের সামনে নিজেকে দুর্বল প্রকাশ করতে চাইছিলনা, কোনো অর্থেই না।
“ঠিক আছে……… আমাকে ১৫ দিনের সময় দাও, আমি ভাবনা-চিন্তা করে তোমাকে জানিয়ে দেব।”
“It’s ok….!”
অতঃপর তারা ফিরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল।
সাহারা ইনিস্টিটিউটে আগামী পরশু তাঁর শো। নিজের ল্যাপটপ হাতে একটু দ্রুততার সঙ্গেই সিড়ি বেয়ে উঠছিল কারণ আজ তাঁর সাহারা ইনিস্টিটিউটের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে প্রথম মিটিং। ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কেবিন এর সামনে রামলা অপেক্ষা করছিল, P.A -এর ডাকে সাড়া দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে তাঁর সাক্ষাৎ হল এক অসম্ভব সুন্দরী ও সম্ভ্রান্ত মহিলার সঙ্গে। টেবিল এর উপরে নেমপ্লেটে লেখা মহিলার নাম – সাবা হায়াত খান। অত্যন্ত নমনীয়, মাধুর্য ও আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী। সোনালি ফ্রেম এর ভেতর দিয়ে উঁকি মারা উজ্জ্বল বাদামী চোখ যেন তাঁর বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ করছে। লম্বা, ঢেউ খাওয়া ও সুগঠিত শরীর। কটন শাড়িতে যেন কোনো রূপের দেবী রাস্তা ভুলে এখানে চলে এসেছে। রামলা মহিলার দিকে চেয়েই রইল অতঃপর সালাম জানাল।
“সিট প্লিজ।” অতঃপর তাঁদের মাঝে অনেকক্ষণ ধরে কাজ সম্পর্কিত চিন্তাধারার আদান-প্রদান হতে থাকল। এই মিটিং এর পর রামলা বুঝতে পারল যে সাবা হায়াত খান শুধু সুন্দরীই নয়, মেধাবীও বটে। কাজ-এর প্রয়োজনে আরোও দু-তিনটে সাক্ষাতের মাধ্যমে তারা বেশ ঘুলে-মিলে গিয়েছিল। দু’জনের মধ্যে বেশ আন্ডারস্ট্যান্ডিং হওয়ায় রামলার শো’ও খুব সফল হল। রামলা অত্যন্ত খুশি ও সাফল্যের নেশায় চূর্ণ ছিল। এর মাঝে রামলা জানতে পারে যে, সাবা হায়াত খান অবিবাহিতা এবং তাঁর মায়ের সঙ্গে শহরের এক আচ্ছাদিত অঞ্চলে থাকেন। কাজের প্রয়োজনে রামলার তাঁদের বাড়িতেও যাওয়া আসা ছিল এবগ সাবা-র মায়ের সঙ্গে দেখা করে তাঁর খুব ভালও লেগেছে। তিনি (সাবা হায়াত-এর মা) রামলাকে তাঁর ও তাঁর পরিবারের কথা জিজ্ঞাসা করেন অতঃপর বললেনঃ-
“মাশা’আল্লাহ খুব সুন্দর, বেশ বুদ্ধিমতী। এখন পর্যন্ত বিয়ের কী খবর?”
“এ বিষয়ে আমি এখনও কিছু ভাবিনি।”
এবার আশ্চর্য হওয়ার পালা ছিল সাবা হায়াত-এর
“কেন, দেরি কীসের?”
অতঃপর রামলা, সাবা ও তাঁর মা’কে সব কথা বিস্তারিত ভাবে বলে শোনাল। যখন নিজের গল্প শোনানো হয়ে গেল তখন রামলা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল – “আপনাকে দেখে আমার মনেও একটা প্রশ্ন আছে।”
“আপনি এত সুন্দরী, স্মার্ট পাশাপাশি অত্যন্ত বুদ্ধিমতীও তবু আপনি এখনও বিয়ে করেননি কেন……? ক্ষমা করবেন, কিন্তু প্রথম দিন থেকেই এই প্রশ্ন আমার মনকে অস্থির করে রেখেছে।”
“তুমি না হয়ে যদি অন্য কেউ এই প্রশ্ন করত, তবে কখনও আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতাম না…… কিন্তু রামলা, আমি তোমাকে অবশ্যই এ প্রশ্নের উত্তর দেব আর কেন দেব সেটা তুমি উত্তর শোনার পর নিজেই বুঝে যাবে।”
“আমি আর আমার বড় দাদা আনোয়ার, আমরা দুই-ভাই বোন। দাদা আমার চেয়ে প্রায় আট বছরে বড়। নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পূর্ণ করে চাকরী নিয়ে সে এখন আমেরিকায় সেটেল্ড। আলহামদুলিল্লাহ্ বাড়ির অবস্থা সবসময় ভালই ছিল। আমার বাবা নিজে একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। বাড়িতে কোনো কিছুর অভাব ছিল না। আর আমি ছিলাম ছোট্ট এবং বাবার বড় আদুরে।”
“যখন আমি প্রথম বর্ষের ছাত্রী তখন আমার ছোট কাকা তাঁর ডাক্তার ছেলের বিয়ের জন্য বাবার কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসে। প্রকৃতি যেমন আমাকে সৌন্দর্য্যতার অলংকার দিয়ে অলংকৃত করেছিল তেমনই মেধাও দান করেছিল প্রচুর। তাই আমি পড়াশুনা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমার বাবা যখন বুঝতে পারল যে আমার ইচ্ছে আমি উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে চাই তখন তিনি খুশি মনে আমার ইচ্ছে পূরণে আমার সহোযোগিতা করে। সে সময় বাবার সামনে আমার মায়ের কোনো কথাই চলে নি। আর এভাবে এক-এক করে অনেক ভালো ভালো প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
আমি Fine Arts-এ M.A. করার পর M.Phil. করি। তারপরে অধ্যাপনায় যোগ দিই। যে কলেজে যোগ দিই সেটি ছিল একটি বয়েজ কলেজ, তাই সেখানে নিজের মান ও সম্ভ্রমকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিজেকে কঠোরতার চাদরে মুড়ে নিই। কারণ তখন আমি একজন সুন্দরী মেয়ে তার উপর অবিবাহিতা তাই আমার উপর ছেলেদের দৃষ্টি দেওয়াটা ছিল স্বাভাবি। কিন্তু আমারা চেহারায় সম্মান ও কঠোরতার আবরণের সামনে কেউ দুঃসাহস দেখাতে পারে নি। তবু দু-একজন অবশ্যই খুব ভালো এবং সহজ-সরল প্রকৃতির যুবক ছিল, কিন্তু আমি কঠোরভাবে তাদের প্রপোজালকে রিজেক্ট করে দিই। আমার দৃষ্টিতে আমি একজন শিক্ষীকা আর তারা হলো আমার ছাত্র।
এভাবে পাঁচ বছর কেটে যায়। হঠাৎ বাবা আমাদের সকলকে ছেড়ে পরোকালে পাড়ি দেন। ফলে বাড়ির সমস্ত দায়িত্বের সঙ্গে আমি একা হয়ে যাই। ততদিনে আমার Ph.D. ডিগ্রিও সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তারপরেই সাহারা ইনিস্টিটিউটের অফার আসে আর আমি সাবা হায়াত খান ম্যানেজিং ডিরেক্টরের আসন গ্রহণ করি। এখানে এসে নতুন দায়িত্ব এবং নতুন পরিবেশের সঙ্গে এডজাস্ট হতে হতে কখন যে চার বছর কেটে গেল বুঝতেই পেলাম না। এদিকে বংশে এবং বংশের বাইরেও সকলে আমাকে এক অহংকারী মেয়ে হিসেবে জানতে শুরু করল। নিজের দিকে যখন ভালো করে লক্ষ্য করলাম তখন আমার মাথার চুলে কিছুটা রূপোলী আভা অনুভব করলাম। আমার চেহারা এক যুবতী মেয়ের চেহারা না হয়ে এক প্রৌঢ়া মহিলার চেহারার মতো দেখতে মনে হচ্ছিল। যেখানে আমাদের বংশের আমার সমবয়সী মেয়েরা তাঁদের সন্তান-সন্ততি নিয়ে সুখের সংসার করছে তার ঠিক উল্টোদিকে আমি জীবনের মরুভূমিতে প্রখর রৌদ্রে একা দাঁড়িয়ে। আমি আমার সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় নিজ হাতে নিজের যৌবনকে নষ্ট করেছি। এখন যদিও দু-একটা প্রস্তাব আসে সেগুলো হয়তো তালাকপ্রাপ্ত নয়তো দু-এক সন্তানের বাবা। তাই আমি এ বিষয়ে ভাবা ছেড়ে দিয়েছি।”
“কখনো এমন হয় যে অল্পের জন্য জীবন আমাদের হাত এর নাগালে পেরিয়ে যায় আর আমরা ভুল বোঝা বুঝির মধ্যে আটকা পড়ে থাকি। তুমি ভুলেও কখনো এমন ভুল করো না। জীবনকে বোঝো, যৌবনের কদর করো। দেখো রামলা জীবন বার বার পেছন ফিরে আওয়াজ দেবে না। আজ আমি জীবনযাত্রার দীর্ঘ এবং কঠিন পথে একা ও নগ্ন পায়ে চলেছি, পরিস্থিতির প্রখর রৌদ্র ছাড়া কেউ আমার সঙ্গে নেই। তোমার জন্য আমার একটাই পরামর্শ যে, আতিফকে নিজের করে নাও রামলা। ভবিষ্যত অবশ্যই জরুরী কিন্তু জীবনের থেকে বেশি জরুরী নয়। কোথাও এমন যেন না হয়ে যায় যে, অবশেষে আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই রইল না।”
কথাগুলো বলতে বলতে তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। হিচকির আওয়াজে রামলা যখন ফিরে তাকাল, দেখল যে সাবা-র মায়ের চোখে অশ্রু, সাবা-রও চোখ ছিল অশ্রু সিক্ত। তিনি চশমা নামিয়ে চশমার কাঁচ পরিস্কার করতে সামনে রাখা জলের গ্লাস তুলে এমন ভাবে পান করে যাচ্ছিলেন যেন জীবনের সমস্ত তিক্ততাকে গিলে নিতে চান!
সাবা হায়াতকে দেখে রামলা আজ স্পষ্ট বুঝে গিয়েছিল যে, যেই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী ও উচ্চপদে আসীন মহিলাকে দেখে সে ঈর্ষান্বিত হত সেই আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী আসলে ভেতরে থেকে কতই না একাকীত্বের জীবন যাবন করছে। রামলা আচমকা উঠে দাঁড়াল –
“আচ্ছা অনুমতি দিন…… এবার আমি যাই… আল্লাহ হাফিয!”
সাবা একটু হাসলেন তিনি জানতেন যে, রামলা আর থামবে না… “আল্লাহ হাফিয।”
রামলা বেরিয়ে এলো। কোথাও দূর গগনে যেন এক সিনেমার গানের গুঞ্জন ভেসে আসছে –
‘চাহে জো হামে পুরে দিল সে
মিলতা হায় ওহ বাড়ি মুশকিল সে
উসকে হাথ কো তুম থাম লো
ও মেহেরবাঁ ফির হো না হো
হার ঘড়ি বাদাল রাহি হায় রূপ জিন্দেগী…………’
সাবা হায়াত খানের বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই রামলা আতিফ জিলানীকে ফোন করে।
আবেগ ও উত্তেজনায় রামলার গলার স্বর যেন কাঁপছিল। আতিফ ফোন রিসিভ করায় রামলা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে চলল –
“আতিফ তুমি কোথায়? তোমাকে খুব মনে পড়ছে……… আর…… আর আমরা কবে দেখা করছি আতিফ…… আমি তোমার সব কথা মানতে রাজি, তুমি শুনছো তো আতিফ…, আতিফ কিছু বলোনা……!”
ফোনের ওপাশ থেকে শান্ত স্বরে আতিফ বলল –
“আচ্ছা…… স’ব কথা………? ভেবে নাও কিন্তু………।”
লজ্জায় যেন রামলার গাল দুটো লাল হয়ে উঠল। লজ্জা পেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে রামলা ফোন রেখে দিল।
চারিদিকে যেন খুশির জলতরঙ্গ বেজে উঠেছে আর জীবনের প্রতিটি দরজায় যেন এক সুখের সকাল কড়া নাড়ছে।।
মতামত দিন