
না-ফেরার দেশে
লিখনেঃ আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
না-ফেরার দেশে প্রোফেসর ড. জ়িয়াউর রহমান আ’জ়ামী
-----------------------------------------------------------------------------------------------
প্রাথমিক জীবন
প্রোফেসর ড. জ়িয়াউর রহমান আ’জ়ামী একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিশ্ববিখ্যাত পন্ডিত। অসংখ্য বইয়ের লেখক। পূর্ব নাম বাঙ্কেরাম। ১৯৪৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড় জেলার বালরিয়াগঞ্জ গ্রামে এক হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। শৈশব থেকেই ধর্মের বিষয়ে প্রচণ্ড আগ্রহী ছিলেন। প্রবল আগ্রহের কারণে ছেলে বেলাতেই বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ে নিজেই পড়াশোনা ও গবেষণা শুরু করেন। তাঁর অধ্যয়ন, পড়াশোনা ও গবেষণা তাঁকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। অবশেষে ১৮ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন।
শিক্ষা জীবন
তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পড়াশোনা করেছেন। শিবলী কলেজ, আজমগড় থেকে পাঠ সম্পূর্ণ করে বেরিয়ে পড়েন উচ্চ শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে। দারুস সালাম বিশ্ববিদ্যালয়, উমরাবাদ থেকে ‘আলেমিয়্যাত ও ফাজ়িলাত ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর সৌদি আরব যাত্রা করেন। সেখানে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং মক্কার উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেন। তারপর মিশরের বিখ্যাত আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেন।
কর্ম জীবন
কর্ম জীবনে তিনি নানা কাজ ও নানা দায়িত্ব অত্যন্ত মনোযোগ ও দায়িত্ব সহকারে পালন করেছেন। মক্কা মুকার্রামায় অবস্থিত রাবেত়া ‘আলম-ই-ইসলামী’র বিভিন্ন পদে নিযুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। শেষে ওই সংস্থার জেনারেল সেক্রেটারী পদও অলংকৃত করেন। এছাড়া ১৩৯৯ হিজরীতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোফেসর হিসেবে শিক্ষকতার জীবন শুরু করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট থিসিসগুলো নিরীক্ষণ এবং খসড়া তৈরি করার গুরুত্বপূর্ণ কাজও তিনিই সম্পাদন করতেন। এসবের পাশাপাশি আল্-বাহ়সুল্ ‘ইল্মী’র পরিচালক, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাগাজিন-এর সদস্য এবং হাদীস অনুষদের অধ্যক্ষ ছিলেন।
গবেষণা ও দাওয়াহ্ সহ নানা কাজে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, মিশর, জর্ডন, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নেপাল, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত ইত্যাদি দেশে একাধিক বার ভ্রমণ করেছেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি তিনি প্রাচীন পদ্ধতিতেও বিভিন্ন শায়েখের সান্নিধ্যে পৌঁছে হাদিস ও শরিয়াহ্র জ্ঞান অর্জন করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন— আল্লামা শায়েখ আবদুল্লাহ ইবনে হামিদ রহ (প্রধান বিচারপতি সৌদি আরব), আল্লামা শায়েখ আবদুল আজিজ বিন বায রহ (উপাচার্য-জামিয়া ইসলামিয়া এবং তৎকালীন গ্র্যান্ড মুফতি, সৌদি আরব), শাইখ ইবনু বায রাহঃ তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। দক্ষিণ ভারতের শায়খুল্ হাদীস মাওলানা আব্দুল ওয়াজিদ ‘উমরি রহমানী, মাওলানা আবুল্ বায়ান হাম্মাদ ‘উমরি প্রমুখ।
এছাড়া তিনি নিয়মিত মসজিদে নববীতে স়াহ়ীহ় বুখ়ারী এবং স়াহ়ীহ় মুসলিমের দার্স (পাঠ) দান করতেন। বিখ্যাত স়াহাবি আবু হুরায়রার পক্ষে থিসিস করে আবু হুরায়রার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ খণ্ডন করেন। শাইখ আলবানী রাহঃ তাঁকে স্নেহ করে সাহিবু আবি হুরাইরাহ বলে ডাকতেন। তিনি হিন্দি এবং আরবী উভয় ভাষায় বহু গ্রন্থ রচনা এবং সংকলন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি একাগ্রতার সাথে অধ্যয়ন ও গবেষণা কর্মে লিপ্ত ছিলেন।
মৃত্যু
সপ্তাহ খানেক আগে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ৩০ জুলাই, ২০২০ জোহর নামাযের কিছুক্ষণ আগে ইহলোক ত্যাগ করেন— ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজে’উন।
অবদান
আরবি ভাষায় তিনি বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য রচনা হল—
(১) আবু হুরায়রাহ্ ফি যাওয়ি মারবিয়াতিহি (أبو هریرة في ضوء مرویاته)
(২) আকযিয়াতু রাসুলিল্লাহ লে-ইব্নিত্ তালা' (أقضیة رسول الله ﷺ لابن الطلاع)
(৩) দিরাসাতুন ফিল্-জার্হি ওয়াত্ তা'’দীল (دراسات في الجرح والتعدیل)
(৪) আল্-মাদ্খাল ইলাস্ সুনানিল্ কুব্রা লিল্-বাইহাকী (المدخل إلی السنن الکبری للبیهقي)
(৫) দিরাসাতুন্ ফিল্ইয়াহুদিয়্যাতি ওয়ান্-নাস্রানিয়্যাহ্ (دراسات في الیهودیة والنصرانیة)
(৬) ফুসূলুন্ ফি আদ্ইয়ানিল্ হিন্দি (فصول في أدیان الهند)
(৭) ফাত্হুল গাফূর ফী ওয়ায্’য়িল আইদী ‘আলাস্ সুদূর লিল্’আল্লামা মুহাম্মাদ হায়াত আস্-সিন্দী (فتح الغفور في وضع الأیدي علی الصدور للعلامة محمد حیاة السندي)
(৮) সালাসাতু মাজালিস মিন আমালী ইব্নু মার্দাওয়াইহ্ (ثلاثة مجالس من أمالي ابن مردویه)
(৯) মু’জামু মুস্তালাহাতিল্ হাদীস ওয়া লাতাইফিল্ আসানীদ (عجم مصطلحات الحدیث ولطائف الأسانید)
(১০) আল্-মিন্নাতুল্ কুব্রা শার্হু ওয়া তাখ্রীজুস্ সুনানিস্ সুগ্রা লিল্-হাফিয আল্-বাইহাকী (المنة الکبری شرح وتخریج السنن الصغری للحافظ البیهقي)
(১১) আত্-তামাস্সুক বিস্-সুন্নাতি ফিল্ আকায়িদি ওয়াল্ আহ্কামি (التمسک بالسنة في العقائد والأحکام)
(১২) তুহ্ফাতুল্ মুত্তাকীন ফী-মা সাহহা মিনাল্ আজকারি ওয়ার্ রুকা ওয়াত্ তিব্বি ‘আন্ সাইয়িদিল্ মুর্সালীন (تحفة المتقین في ما صح من الأذکار والرقی والطب عن سید المرسلین)
(১৩) আল্-জামে’উল্ কামিল ফিল্ হাদিসিস্ সাহীহ আশ্-শামিল (الجامع الکامل في الحدیث الصحیح الشامل) (১৪) আল্-আদাবুল্ ‘আলী (الأدب العالي)। এছাড়া দু’টি বই হিন্দিতেও লিখেছেন, যথাক্রমে কুরআনের শীতল ছায়া ও কুরআন বিশ্বকোষ।
রাহিমাহুল্লাহ!
মতামত দিন