জলরঙ আর তুলির আঁচড়ে সাদা পাতায় ধীরে ধীরে ফুটে
উঠছে একটা অস্পষ্ট ফুলের ছবি। বারান্দার মেঝেতে ছড়িয়ে আছে রঙ, তুলির বাক্স, কাগজ,
পেন্সিল। মাঝে মাঝে এভাবেই সময় যেনো চোখের পলক না ফেলতেই
ফুরিয়ে যায়। ভেজা কাগজে গাঢ় নীল ছোপ। ধোঁয়াটে কালচে আকাশ। এক টুকরো ঘাসের জমি আর
তার মধ্যে নীল ফুল ফুটে রয়েছে। হাওয়ায় কাঁপছে ঝিরিঝিরি পাতাগুলো। কি সুন্দর ছবি
আঁকে রুপু। কোনোদিন শেখেনি। ওই মাকে দেখতো ছবি আঁকতে সেখান থেকেই হাতেখড়ি। ছবিটার
রঙ শুকিয়ে গেলে দেখিয়ে নিয়ে আসবে মাকে।
দোতলার অন্ধকার ঘরে আলো জ্বলে ওঠে। রুপু চমকে
পিছন ফিরে তাকায়। কাজের মাসি ঘর ঝাড় দেবে। মাথা গুঁজে ছবি আঁকছিলো, খেয়াল করেনি কখন হাল্কা অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারিদিক। রুপু
তাড়াতাড়ি আঁকার সরঞ্জাম গুটাতে থাকে।
পূবের জানলা দিয়ে অগণিত তারা বুকে নিয়ে রাতের
আকাশ দেখা যাচ্ছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এভাবে রাতের আকাশ দেখতে রুপুর খুব ভালো লাগে।
দেওয়াল ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। চারিদিক নিঝুম। সারাদিনের কোলাহল বুকে নিয়ে
ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ছে শহরটা। রুপুর বাবা এইসময় একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনে
সিগারেট খায়। তীব্র গন্ধ ভেসে আসে বাতাসে। রুপুর কিন্তু খুব ভালো লাগে এই
গন্ধটা..... কিরকম একটা বাবা বাবা গন্ধ। বাবার ঘরে ঢুকলেই পাওয়া যায় একটা সুন্দর
গন্ধ। অনেকটা আফটার শেভ লোশন আর সিগারেট এর গন্ধ মিলেমিশে তৈরী। বাবাকে খুব অসহায়
আর একা মনে হয় রুপুর মাঝে মাঝে। ওর বারো বছরের বুদ্ধিতে যা বলে।
রুপুর ঘরের খাটের দিকে মাথার কাছে দেওয়ালে
অলকানন্দার একটা সুন্দর হাসিমুখ সাদাকালো ছবি, চোখে গাঢ় কাজল। রুপুর মাকে এবাড়ির সবাই নন্দা বলে ডাকতো। নীল ফুল আঁকা জলরঙের
ছবিটা রুপু মায়ের ছবির সামনে তাকের ওপর রেখে দিয়েছে। মা সারা রাত ধরে দেখবে। খোলা
জানলা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া আসছে। বাগানের হাস্নাহেনার গন্ধে বাতাস আকুল। জানলা দিয়ে
নিমের বাতাস আসছে। তির তির করে হাওয়ায় কাঁপছে পাতাগুলো। গাছটার দিকে তাকালে মায়ের
কথা আরও বেশি করে মনে হয়। মা বলতো – “নিমের
হাওয়া শরীরের জন্য খুব উপকারী।”এছাড়া রুপু আর ওর বাবাকে জোর করে নিমপাতা ভাজা আলু সিদ্ধ মরিচ দিয়ে মাখা
খাওয়াতো। এটা মায়ের একটা পছন্দের পদ ছিলো। এখন মা নেই সেভাবে জোর করার কেউ নেই, তাই সেসব চুকে বুকে গেছে।
রাতের আকাশ বড় নিবিড়, বড় স্নিগ্ধ। ওর মায়ের চোখের কাজলের মতো। মায়াময় আবেশে
জড়ানো। রুপু মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে ওই কাজল কালো আঁধারের বুকে গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
একসময় ঘুমের মধ্যে টের পায় বাবা এসে ওর গায়ে চাদরটা অনেক যত্ন করে টেনে দিচ্ছে।
রুপু ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরে শূন্য বিছানায় অভ্যস্ত হাতে মাকে খোঁজে। অন্ধকারে ধীর
পায়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায় রুপুর বাবা। পাঁচ মাস হলো অলকানন্দা চলে
গেছে.....পিছনে ফেলে রেখে গেছে ওর সাধের সংসার আর খুব কাছের কিছু মানুষ যারা আজও
নিভৃতে একাকী জীবনের স্মৃতির আঙিনায় হাতড়ে বেড়াচ্ছে ওর অস্তিত্ব.... হৃদয় দিয়ে
মর্মে মর্মে অনুভব করছে ওর পেলব কোমল পরশটুকু।
মতামত দিন