কিন্তু আমার ভেতরে তখন যন্ত্রণার আগুন দাউ দাউ করছে। যেন একটা চিৎকার ভেতর ভেতর ফেটে যাচ্ছে যা বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছে কিন্তু পারছে না। এবং সেটা বুকের ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে আছাড় খাচ্ছে।
জুনেইরা, আজ পর্যন্ত আমি তাঁকে দেখিনি, শুধু ফোনেই
আমাদের কথা হয়। তাঁর ম্যাসেজগুলো অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।
ফেসবুক থেকেই আমাদের আলাপ। সে প্রথম আমাকে ম্যাসেজ
করে, ফেসবুক চ্যাটেই আমাদের কথা হতে থাকে। সে আমাকে জানায় যে, সে নাকি আমার খুব বড়
ভক্ত, আমার ফ্যান। আমার কবিতাগুলো নাকি তাঁর খুবই পছন্দ, খুব ভালো লাগে। এমনকি আমার
ফেসবুকের পোস্টগুলোও শেয়ার করে।
একদিন সে আমার ফোন নম্বর চায়। আমি জানি না যে আমার
ব্যক্তিত্ব কত বড়? তবে আমি নিজেকে কোনদিন আহামরি এমন কিছুই ভাবিনি। আমি সকলকেই আমার
ফোন নম্বর দিতাম, স্বভাবত তাকেও দিয়ে দিই। প্রায়ই সে আমাকে ফোন করত আর আমরা বিভিন্ন
বিষয় নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতাম। জুনেইরার সাথে একটা দীর্ঘ সময় ধরে কথা হওয়ার
ফলে আমারও তাঁকে ফোন করার, তাঁর সঙ্গে কথা বলার অভ্যেস হয়ে ওঠে। তাঁর জন্য আমি নিয়ম
করে ফোন কল-এর প্যাকেজ রিচার্জ করতাম, যেন আমাদের মাঝে কথা বলার ধারাবাহিকতা এবং সুখ-দুঃখ
আদান-প্রদান -এর ধারাবাহিকতায় ব্যাঘাত না ঘটে।
সে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ম্যাসেজ করত, যা একটা মাত্রায়
এসে বাকি সব বিষয়গুলো কমতে কমতে বেশিরভাগ গল্প এবং কথা-বার্তাগুলো প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার
দার্শনিক কথা-বার্তায় এসে পৌঁছায়।
কোন এমন একটা দিন কাটত না যেদিন আমাদের কথা হত
না।
আমাদের অজান্তেই যেন নামহীন একটা সম্পর্ক ডুয়েল
হয়ে গিয়েছিল। যেটা বিশেষ করে আমার পক্ষ থেকে কোনদিন শেষ হওয়ার ছিল না। যে সম্পর্ককে
আমি কোনদিন ভোলার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। কেন না আমি জানতাম যে, জুনেইরা একজন
সুযুক্তিবাদী নারী। যার সঙ্গে কথা বলার পর আপনি বা আমি এটা বলতে পারব না বা ভাবতে পারব
না যে, আমার-আপনার সময়ের অপচয় হয়েছে। তাছাড়া আমার জীবন-পরিধীও ছিল বেশ সীমাবদ্ধ। সামান্য
একটু প্রভাতী সমীরণও যেন আমার কাছে সুগন্ধযুক্ত মনোরম হাওয়া মনে হত।
অতঃপর একদিন তাঁর ম্যাসেজ এলো, তাঁর নতুন বই লঞ্চ
হতে চলেছে। শহরের কোন এক পাঁচ তারা হোটেলে তাঁর ওপেনিং সেরেমনি। সে চায় আমিও যেন সেই
অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তাঁকে উৎসাহ বা বাহবা দিই অথবা তাঁকে বাহবা পেতে দেখি।
আমি আমার একমাত্র স্যুট পরে হোটেলে পৌঁছলাম। গেস্টদের
অভ্যর্থনা জানাতে কিছু সুন্দরী ললনা হোটেলের দরজায় ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
আমি হল-এ পৌঁছলে জুনেইরা দ্রুত পা চালিয়ে আমার
দিকে এলো। আমাদের একজনের আর একজনের চোখে চোখ পড়তেই একে-অপরকে চিনতে পেরে যাই।
সে খুব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে নিজের পরিচয় দিল
– “আমি হলাম আপনার………”
আমিও হেসে তাঁর মুখের কথা কেড়ে বললাম – ভক্ত।
সে আরো হেঁসে বলল – “জ্বী হাঁ জ্বী হাঁ”
আসলে তাঁর আকর্ষনীয়ে ব্যক্তিত্বের কারণে আমিও তাঁর
দিকে আকৃষ্ট হতে থাকি।
ইতিমধ্যে এক সামাজিক এবং রাজনৈতিক মহিলাকে বেশ নরম-গরম
ভাবে স্বাগত জানানো হচ্ছিল, মনে হলো সে কোন মুখ্য অতিথি।
প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে, কয়েকজন বেশ ভালো ভালো ভালো
বক্ত্যব্য রাখলেন। বক্তাগণ গ্রন্থাদির যেসব উক্তি প্রদান করলেন সে উক্তিগুলো যেন সব
আমার রপ্ত। যেন মনে হচ্ছিল উক্তিগুলো আমিই বলছি।
অতঃপর জুনেইরাকে তার নতুন গ্রন্থ সম্পর্কে কিছু বলার
জন্য ডাকা হলো।
প্রথমতঃ সে বলল যে, তাঁর এই গ্রন্থ তার সত্য প্রেমের,
তার ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি।
এই গ্রন্থে সে তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে ঘটে যাওয়া যাবতীয়
প্রেম-কাহিনীর বর্ণনা দিয়েছ। দীর্ঘ একটা সময় ধরে তার প্রেমিকের সাথে মনের যে আবেগের
আদান-প্রদান করে এসেছে জুনেইরা সব কিছুই এই গ্রন্তে সুরক্ষিত করে দিয়েছে যা শুধুমাত্র
তার ভালোবাসার মানুষের আবেগের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট করে।
কিন্তু যখন সে বলল, তার প্রিয়তম, প্রাণ-প্রিয় ভালোবাসার
মানুষ এই ইহজগৎ-এর মায়া ত্যাগ করে তাঁকে একলা ছেড়ে পরকালে পাড়ি দিয়েছে। এ কথা শোনা
মাত্র হলরুমে যেন একটা স্তব্ধতা ছেয়ে পড়ল। শ্রোতাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল।
কিন্তু আমার ভেতরে তখন যন্ত্রণার আগুন দাউ দাউ করছে।
যেন একটা চিৎকার ভেতর ভেতর ফেটে যাচ্ছে যা বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছে কিন্তু
পারছে না। এবং সেটা বুকের ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে আছাড় খাচ্ছে।
আমি কী করব?
তাৎক্ষণিক অবস্থা যেন কেমন একটা আশ্চর্য্য রূপ ধারণ
করে নিয়েছিল। নিজেকে বড্ড অসহায় এবং অর্থহীন মনে হচ্ছিল।
আমার বুকের ভেতর একটা দীর্ঘ মেয়াদী এবং কখনও শেষ না
হওয়া একটা চিনচিনে ব্যাথা করছিল।
মতামত দিন