
লড়াই
কলমেঃ নাসরিন সুলতানা
ছোটগল্পঃ লড়াই
--------------------------------------------------------------
প্রতিদিনের মতো আজও বিনয় ক্লাসে দেরি করে আসাতে স্যারের বকাবকি শুনলো। প্রতিদিনের মতো আজও মাথা নীচু করে ক্লাসে প্রবেশ করলো। এ যেন তার নিত্য দিনের অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ক্লাসে রোজ দেরি করে আসা বা বকাবকি খাওয়া এগুলো দেখাও যেন সবার অভ্যেস হয়ে গেছে। তাই এসব নিয়ে কারও কোন আগ্রহ ছিল না। এভাবেই চলতে থাকে। মাষ্টারমশাইকে শুধু বিনয়কে বকাবকি করতেই দেখা যায়। কোনদিন জানতে চাননা তার এই দেরির পেছনে কারণটা কি। কিংবা বিনয়কেও বলতে শোনা যায়নি কখনও। শুধু মাথা নীচু করে থাকতেই দেখা যায়।
বিনয় ক্লাসে খুব যে একটা পরিচিত তা নয়। আর কতগুলো সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মতো সেও একজন। কাজেই তার সমস্যা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি কখনও। তাকে কারও সাথে সেভাবে মিশতেও দেখা যায়নি। বিনয়কে শুধু ক্লাসে দেরি করে আসার কারণে স্যারের বকাবকি শোনার জায়গাটিতে দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সকলে। আর তাছাড়া তার কথা ভাববে সেই সময়ই বা কার কোথায়।
আমরা শুধু ভাবতাম বিনয় রোজ যে বকাবকি শোনে, এসব ভালো লাগে ওর? একটু আগে আসলেই তো হয়। এই সবকিছু নিয়ে ওর ওপর একটা বিরক্তি কাজ করতো। রাগও হতো। এত কিছুর পরেও কেন ও পরিবর্তন যে হয়না। কেমন যেন বিনয়টা। বাস্তব যে বড়ই কঠিন, তাকে চাইলেও যে পরিবর্তন করা যায় না। এসব আমরা ভাবিনি কখনও।
এসব কিছুর অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বেরিয়ে এলো বিনয়ের পেছনে লুকিয়ে থাকা সেই সত্যটা। সেদিন সব রাগ বিরক্তি চাপা পড়ে ওর জন্য মনে জমা হলো অনেকটা ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। চোখে এলো জল। আর বুঝলাম বাস্তব যত কঠিনই হোক না কেন, তাতে যত প্রতিকুলতাই আসুক না কেন, তাকে কাটিয়ে মাথা নীচু করে দিন চালিয়ে দেয় বিনয়ের মতো ছেলেরা। যাদের খবর কেউ রাখে না। এসব বিনয়েরা তাদের কষ্টের কথা কাউকে প্রকাশও করে না কখনও। সব কিছুর সাথে তালে তাল মিলিয়ে চলতে হয় তাদের। শুনতে হয় অনেক কথা। করতে হয় লড়াই।
সেদিন স্কুলে যাইনি আমি। বাজারে বেরিয়েছিলাম মার সাথে। ফুটপাত দিয়ে হেটে যাচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়ল বিনয়। চাল নিয়ে বসে আছে ফুটপাথে। চাল বিক্রি করছে। ঘড়িতে তখন ১০ টা ৪৫। বিনয়ের পরনে আছে স্কুল ইউনিফর্ম, পাশে রাখা আছে বইয়ের ব্যাগটা। ছটফট করছে বিনয়। রাস্তার দিকে বারবার তাকচ্ছে, মনে হচ্ছে ও কারো জন্য অপেক্ষা করছে। আর বারবার ঘড়ি দেখছে। হয়তো স্কুলের টাইম আর কতো বাকি ও সেটাই লক্ষ করছে। কারণ সময় তখন প্রায় শেষের দিকে। আমি ওকে ভালোভাবে লক্ষ্য করছিলাম। ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই একজন বয়স্ক প্রতিবন্ধী হুইল চেয়ার করে আসলেন। বিনয় তাড়াতাড়ি করে মানুষটাকে সাবধানে ধরে নামিয়ে বসিয়ে দিলো চালের সামনে। আর বইয়ের ব্যাগটা নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেল স্কুলের দিকে। যাবার সময় পিছন ফিরে বলে গেলো ‘বাবা এলাম’। বাবা হাতটা তুলে কি যেন বলল বিনয়কে। ঠিক বুঝতে পারলাম না। আসলে বোঝার চেষ্টাও করলাম না।
কারণ ততক্ষণে চোখে ভেসে উঠল বিনয়ের সেই মুখটা। আজও দেরি হয়ে গেল তার। স্যার হয়ত এতক্ষণে ক্লাসে ঢুকে পড়েছেন। ঘড়িতে ১১ টা ০৫ বাজে। বিনয়কে আজও শুনতে হবে স্যারের বকাবকি। হয়তো আজও সে মাথানীচু করে প্রতিদিনের মতো দাঁড়িয়ে আছে……।
অজান্তেই চোখ দিয়ে বেয়ে এলো জল। মনে হলো আমাদের সমাজে এমন কত বিনয় আছে, যারা জীবন আর সমাজের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে। যাদের খবর কেউ রাখে না। আর এভাবেই মাথা নীচু করে সহ্য করে যাচ্ছে ক্লাসের স্যারের মতো আরও কতো মানুষের বকাবকি। তবুও তারা থেমে থাকে না। এ যেন তাদের জীবন যুদ্ধের লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই।।
মতামত দিন