
কুসুমের সুইসাইড নোট (শেষ পর্ব)
লেখকঃ মুহাম্মদ ফারহান ইসলাম নীল
ছোটগল্পঃ কুসুমের সুইসাইড নোট
---------------------------------------------------
বাস স্টপে এসে সাদিয়া পরিবহনের বাসে চড়লাম। একটু পরেই বাস ভো ভো করে ছুটে চললো। আমার আত্মীয়র বাড়িতে যেতে লজ্জা লাগলেও বাস জার্নি করতে ভীষণ ভালো লাগে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে প্রতিদিন যদি আট ঘন্টা করে বাস জার্নি করতে পারতাম খুব ভালো লাগতো।
দীর্ঘ দুই ঘন্টা বাস জার্নি করার পর রিনি আপার শ্বশুড় বাড়িতে পৌঁছালাম। রিনি আপা বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখেই হাসতে হাসতে আমার কাছে এসে বললো,
“অবশেষে আমার দুষ্ট ভাইয়া আমার বাড়ি খুঁজে পেয়েছে?”
আমিও মুচকি হেসে জবাব দিলাম, “খুঁজে না পেলে রেহাই আছে নাকি?”
“ভিতরে চল তারপর তোর ব্যবস্থা করতেছি।”
আপা আমাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল। অনেক দিন পর এলাম তাই বাড়িটাকে কেমন জানি নতুন নতুন লাগছে। আমার কেন জানি মন চাচ্ছে ইশ্ আমার যদি এমন শ্বশুড় বাড়ি থাকতো! দশ কাঠা জমির উপর বিশাল একটি বাড়ি। পুরো বাড়ি জুড়ে বিভিন্ন রকমের গাছে ভরা। তবে এই বাড়িতে রিনি আপা এবং তার একমাত্র মেয়ে হুরাইয়া তিশা এবং বিজনেজম্যান স্বামী হুমায়নকে নিয়ে বসবাস করে। আপার শ্বশুড় শ্বাশুড়ী এই পৃথিবী ছেড়েছেন রিনি আপার বিয়ের তিন বছর পর।
আপা বললো, জার্নি করে খুব ক্লান্ত হয়েছিস যা গোসল করে খাওয়া কর তারপর রেস্ট নে।
আমি ফ্যানের নিচে বসে একটু ঠান্ডা হয়ে গোসল করতে গেলাম। গোসল করে ফিরে এসে দেখি আপা আমার জন্য ভাত রেডি করে বসে আছে। টেবিলে তরকারির বাটির অভাব নেই। এতো গুলো তরকারির বাটি দেখে আমি মুচকি হেসে বললাম,
“আপা তুমি কী আমাকে খাইয়ে মেরে ফেলার জন্য প্ল্যান করেছো নাকি?”
“ধুর পাগলা। বোনেরা কখনো ভাইদের মারতে পারে নাকি? কি যা তা বলছিস?”
“নয়তো কি? আমার জীবনে আমি এতো খাবার খেয়েছি নাকি?”
“তোর পেটে যতোটুকু ধরবে তুই ততোটুকুই খাবি।”
“হুম তাই তো। তাই বলে তুমি এতো......”
“আচ্ছা তুই খেতে তো শুরু কর।”
আমি হাত ধুয়ে বিসমিল্লাহ বলে খেতে শুরু করলাম। তরকারির বাটি দেখেই আমার পেট ভরে গেছে। বুঝতে পারছি না ভাত খাবো কিভাবে? আমার সামনের চেয়ারে রিনি আপা বসে আছে।
“কি রে খাচ্ছিস না কেন? লজ্জা লাগছে বুঝি? তোর তো আবার মেয়ে মানুষের মতো লজ্জা। সামনে কেউ থাকলে খেতে পারিস না। আচ্ছা তুই খা আমি একটু বাইরে থেকে আসি।”
এই কথা বলে রিনি আপা চলে গেল। আমি দুই লোকমা ভাত মুখে দিয়ে জোর করে গিলে ফেললাম। তারপর ভাবলাম আমার হাত ধোয়া উচিৎ। বাম হাতে গ্লাস নিয়ে যেই হাতে পানি ঢালবো অমনি কে যেন বলে উঠলো, বেয়াই সাহেব হাত ধুবেন না প্লিজ। আমি মাথা তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম নীল রঙের শাড়ি পরা একটি সুন্দরী মেয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে। তারপরও ভালো করে চেনার জন্য আমি বললাম, আপনি কে গো?
এবার মেয়েটি আমার কাছে এগিয়ে এসে রিনি আপা যে চেয়ারে বসেছিল সেই চেয়ারে বসে বললো,
“বেয়াই সাহেব আপনি আমাকে চিনতে পারেননি? আমার আপনার বেয়াইন কুসুম।”
এবার আমি ঠিকঠাক চিনে ফেললাম। এই সেই সুন্দরী বালিকা কুসুম। যে কিনা রিনি আপুর বিয়ের সময় আমার ইজ্জতের আঠারোটা বাজিয়েছিল। ভাগ্যিস রিনি আপুর ননদ বলে আমি ছাড় দিয়েছিলাম। নইলে কুসুমের সাথে আমার অনেক কিছু হয়ে যেতো। থাক সে পুরোনো কথা। পুরোনো স্মৃতি খুঁজতে গেলে অন্তরে ভালোবাসা জাগবে। হয়তো আমি কষ্ট পাবো নয়তো কুসুম বেয়াইন কষ্ট পাবে।
“এবার চিনতে পেরেছেন বেয়াই সাহেব?”
আমি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম, আপনাকে কিভাবে ভুলে যাবো বেয়াইন। আপনি তো মিশে আছেন আমার অন্তর জুড়ে। যদিও রিনি আপার বিয়ের সময় কুসুমের সাথে একটু আধটু দুষ্টমি, খুনশুটি হয়েছিল। এর পর সেভাবে কুসুমের সাথে কথাবার্তা হয়নি। হলেও সেভাবে নয়। রিনি আপার ননদ বলেই বেশি কিছু বলা হয়নি।
আমার কথা শুনে কুসুম বললো,
“বাহ বেয়াই সাহেব শহরে থেকে তো ভালোই ঢপ মারতে শিখে গেছেন। আজকাল আমার সাথেও ঢপ মারতে শুরু করেছেন দেখছি।”
“আরে নাহ বেয়াইন আমি ঢপ মারবো কেন? যা সত্যি তাই বলছি। আপনার মতো সুন্দরী বেয়াইনকে কি কেউ ভুলে থাকতে পারে বলেন?”
“আপনার মতো মানুষ হলে পারে। আপনি তো মানুষ নন আপনি একটা পাথর। আপনার যদি মন থাকতো তাহলে বেয়াইনের খোঁজ খবর রাখতেন। মাঝে মাঝে আমার নাম্বারে কল দিয়ে কথা বলতেন। কিন্তু আপনি সেটা করেননি। আমার নাম্বার কেন? আপনি তো নিজের বোনের খোঁজ খবর ঠিক মতো রাখেন না। আর আমার রাখবেন কিভাবে?
কুসুম কথা গুলো যেভাবে আবেগ নিয়ে বললো তাতে মনে হচ্ছে কুসুমের সাথে আমার অনেক দিনের সম্পর্ক ছিল। আমি কুসুমকে ধোকা দিয়ে চলে গেছি অনেক দুরে। আমি কুসুমের কথা গুলো বুঝেও না বুঝার ভান করলাম।
“কি হলো চুপ করে আছেন কেন জবাব দিন?”
“কি বলবো?”
“জানেন না কি বলবেন?”
“না জানি না। আপনার কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন।”
“যে মানুষটা নারীর মন বুঝে না তাকে আর কি বলবো বলুন?”
কুসুমের কথা গুলো অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। এখন যদি রিনি আপা এসে আমাকে কুসুমের সাথে এভাবে কথা বলতে দেখে তাহলে হয়তো ভাববে কুসুমের সাথে আমার সম্পর্ক আছে সেজন্য আমি আপার বাড়িতে আসি না। তাই আমি কুসুমকে বললাম, বেয়াইন পুরোনো কথা বাদ দিন। অনেক দিন পর এসেছি এখনকার কথা বলুন।
“কতদিনের ছুটিতে এসেছেন?”
“এক সপ্তাহের।”
“আবার কবে চলে যাবেন?”
“আগামী শনিবারে।”
“মাঝখানের তিনটা দিন আমাকে সময় দিতে পারবেন। আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”
কুসুমের কথা শুনে আমার বুকের ভিতর ধুকধুক শব্দ শুরু হলো। বুঝতে পারছি না কি জবাব দিবো। রিনি আপা আমাকে আদর করলেও কুসুমের সাথে কথা বলা দেখলে রাগ করবে। তাই ভাবছি কুসুমকে কি জবাব দিবো।
“কি হলো চুপ করে আছেন কেন?”
আমি সাত পাঁচ না বুঝে হ্যাঁ বলে দিলাম। কুসুম মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো, বুঝেছি আপানার বুকে পাটা গজিয়েছে। এবার আপনাকে পুরুষ বলতে পারি। হি হি হি হি...
কুসুমের সেই মায়াবী হাসি আমার অন্তরে গেঁথে গেল। কুসুমের হাসিটা এতো সুন্দর যে, ওর হাসি দেখলে যে কেউ ফিদা হয়ে যাবে। চাই ছেলে হোক অথবা মেয়ে। কুসুমের কপালের মাঝখানে যেখানে মেয়েরা ছোট্ট কালো টিপ পরে সেখানে একটা পিচ্চি তিল আছে। কুসুমকে যেদিন প্রথম আমাদের বাড়িতে দেখেছিলাম সেদিনই ঐ পিচ্চি তিলটা দেখে আমার ভালো লেগেছিল। আসলে ঐ ভালো লাগাটা ভালো লাগার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
“পায়েস খাবেন?”
“এখন?”
“হুম এখন।”
“সবেমাত্র তো ভাত খেলাম।”
“তাতে কি হয়েছে? অনেক দিন পর এলেন আমার হাতের কিছু রান্না খেয়ে দেখবেন না? শুধু কি ভাবীর হাতের রান্না খেয়ে বিদায় নিবেন? এই বাড়িতে যে আপনার কিউট বেয়াইন থাকে আর সেই বেয়াইন যে মজার মজার রান্না করতে পারে সেটা তো আপনাকে জানতে হবে তাই না?”
“হুম তা তো জানতেই হবে। আমার বেয়াইন বলে কথা।”
আমার কথা শুনে কুসুম মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
“বেয়াই সাহেব আপনি পারেন বটে! কিছু থাকুক আর না থাকুক আপনার চাপা আছে। হিহিহিহি”
আমিও কুসুমের হাসির সাথে হাসতে থাকি।
“বেয়াই সাহেব আপনি বেলকনিতে গিয়ে বসুন আমি পায়েস রান্না করে আনতেছি।”
আমি বেলকনিতে গিয়ে বসে পত্রিকা পড়তে শুরু করলাম। আজকাল পত্রিকায় শুধু ধর্ষণের খবর ছাপানো হয়। পুরো পত্রিকা জুড়ে খুন, গুম, ডাকাতি, ধর্ষণ, ইভটিজিং ইত্যাদি খবরে পুরো পত্রিকা ভর্তি। অথচ একটা ধর্ষকও ধরা পড়ে না বিচারও হয় না।
একটু পরেই কুসুম এসে হাজির হলো। আমার হাতে পায়েসের প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“আপনি পায়েস খান আমি ফ্রীজ থেকে ঠান্ডা পানি আর মিষ্টি নিয়ে আসতেছি।”
এক চামুচ পায়েস মুখে দিয়েই যা বুঝলাম সুন্দরী মেয়েরা আসলেই সুন্দর করে রান্না করতে পারে। অবশ্যি কিছু কিছু সুন্দরী মেয়েরা পাক্কা অলস এবং ফাঁকি বাজ হয়ে থাকে। কুসুমের পায়েস খেয়ে আমার মনে হলো কুসুমের মতো একজন মানুষ আমার জীবনে থাকা জরুরি। আর কিছু পাই না পাই সুস্বাদু পায়েস খেতে পারবো রোজ। কুসুম প্লেটে করে মিষ্টি আর ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে হাজির হলো। দুজনে পায়েস খেলাম।
“বেয়াই সাহেব আমার কথা যেন মনে থাকে। এই তিনটি দিন কিন্তু আমার।”
“অবশ্যই মনে থাকবে।”
“এই নেন আমার ফোন নাম্বার বিকাল বেলা আমাকে কল দিয়েন দুজনে আলতাদিঘির পাড়ে ঘুরতে যাবো।”
আমি কুসুমের ফোন নাম্বার সেভ করে রাখলাম।
“আপনি এখানে বসুন আমি ওয়াশরুম থেকে আসি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
কুসুম চলে যাওয়ার পর আমি আবার পত্রিকা পড়তে শুরু করলাম। পত্রিকার টপ খবর গুলো পড়ে শেষ করলাম। কিন্তু কুসুম ফিরে এলো না। আমি মনে মনে ভাবলাম, কুসুম আবার ওয়াশরুমে পা পিছলে পড়ে যায়নি তো? বেলকনি থেকে রুমে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি ডাইনিং রুমে রিনি আপা বসে আছে। আমাকে দেখে রিনি আপা বললো,
“কি রে কইছিলি এতোক্ষন?”
“এই তো বেলকনিতে বসে পত্রিকা পড়তেছিলাম।”
“এখানে এসেও পত্রিকা পড়তে শুরু করেছিস?”
“কি করবো বলো? সময় তো কাটছে না। তোমার ননদ এসে পায়েস রান্না করে খাওয়ালো। পায়েস খাওয়া শেষ বললো, আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসি। সেই গেল তো গেল। কোনো খোঁজ নেই। দেখো তো বেচারী আবার ওয়াশরুমে চিৎপটাং দিলো নাকি?”
আমার কথা শুনে রিনি আপা হা করে রইলো। “কি হলো আপা হা করে আছো যে?”
“তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? তুই আমার ননদকে কোথায় পেলি?”
“আজব তো কোথায় পাবে মানে? তুমি চলে যাওয়া একটু পরেই তোমার ননদ কুসুম এসেছিল। আমার সাথে গল্প করলো, আমাকে পায়েস রান্না করে খাওয়ালো। তোমাদের ফ্রীজ থেকে মিষ্টি এনে খাওয়ালো।”
“ভাই তুই কি ফাজলামি করতেছিস আমার সাথে। দেখ ভাই আমার কিন্তু ফাজলামি একদম পছন্দ না।”
“কি বলছো আপা। আমি তোমার সাথে ফাজলামি করবো কেন?”
“নয়তো কি? আমার ননদ কুসুম আমার বিয়ের তিন বছর পর সুইসাইড করেছে। আর তুই কিনা বলছিস কুসুম তোকে পায়েস রান্না করে খাইয়েছে। এটা ফাজলামি নয়তো কি?”
রিনি আপার কথা শুনে এবার আমি মুখ হা করে রইলাম। আপা এসব কি বলছে? আপার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? একটা জলজ্যান্ত মানুষ একটু আগেই আমাকে পায়েস রান্না করে খাওয়ালো আর সে কিনা তিন বছর আগে সুইসাইড করেছে। আমি কাকে বিশ্বাস করবো নিজের দুই চোখকে নাকি রিনি আপাকে?
“আপা আমি বিশ্বাস করি না। তুমি মিথ্যা কথা বলছো। চলো তোমার ওয়াশরুমে। দেখবে তোমার ননদ কুসুমকে।”
“আফিফ থাপ্পর খাবি কিন্তু। কুসুমের নাম মুখে নিবি না। তোর বিশ্বাস না হলে আমার সাথে আয়।”
রিনি আপা আমার হাত ধরে নিয়ে গেল ওদের রুমে। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটি ডায়েরি বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো, পড়ে দেখ কুসুম সুইসাইড করার আগে এই চিঠি লিখে গেছে। আমি চিঠিটি পড়তে গিয়ে হোচট খেলাম। কারণ চিঠির শুরুতেই আমার নাম লেখা ছিল। পুরো চিঠিতে কি লেখা হয়েছিল সেটা অজানাই থাকুক।
কুসুম কেন সুইসাইড করেছে সেটাও অজানা থাকুক। কিন্তু এতো বছর পর কুসুমের আত্মা কেন ফিরে এসেছিল এটাও অজানা থাকুক। আমি ডায়েরিটা হাতে নিয়ে রিনি আপার রুম থেকে বের হলাম। আমার চোখের সামনে প্রথম দেখা কুসুমের সেই কপালের মাঝ বরাবর পিচ্চি তিলটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমি কি তাহলে অপরাধী? বুঝতে পারিনি একটা বহমান ভালোবাসার নদীকে। একটা ঝড় এসে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে নদীর বুক। নদীটি হারিয়ে গেছে অচিন সাগরের মাঝে। আর ফিরে আসবে না। পরাপারে ভালো থাকুক পিচ্চি তিলের অধিকারিনী কুসুম।।
সমাপ্ত
মতামত দিন