
কাগজের পোষাক
গল্পকারঃ আলী নিসার
অনুবাদকঃ মোজাহিদুল ইসলাম
কাগজের জামা
----------------------------------------------------------
“আমাকে একটা সিমকার্ড দেবেন” – সে খুব ব্যস্ততার মধ্যে ছিল, হাতে একখানা নুতন সাধারণ মোবাইল ফোন নিয়ে ফ্রাঞ্চাইজির দোকানে কাউন্টারের সামনে দুই-তিন বার একই কথা বলায় দোকানের এক কর্মচারী এসে তাঁর দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললঃ-
“এখান থেকে যে কোন একটা নম্বর পছন্দ করুন, আর আপনার আইডি কার্ড-এর একটা ফটো কপি দেবেন।”
“আইডি কার্ড………? আচ্ছা……… আচ্ছা দিচ্ছি দাড়ান………”
আইডি কার্ড-এর জন্য শার্ট-প্যান্ট-এর পকেটে হাত দিয়েই চমকে উঠল। কোন পকেটে কোথাও আই কার্ড নেই।
“আচ্ছ আপনি বায়োম্যাট্রিক তো করবেন, তবে আই কার্ড-এর কী দরকার?”
“মাফ করবেন, আমরা আইডি কার্ড ছাড়া সিম দিই না।”
“আমি মনে হয় আই কার্ড রুমে ছেড়ে এসেছি। আমার ভাই-এর এক্সিডেন্ট হয়েছে, কিন্তু আমি জানি না যে তাকে কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর তাড়াহুড়োর মাঝে আমি আমার ফোনটাও হারিয়ে ফেলেছি। আমার সিমকার্ডটা নেওয়া অত্যন্ত জরুরী, কারণ আমাকে জানতে হবে আমার ভাইকে কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্লিজ, খুব উপকার হয় যদি আমাকে এটা সিমকার্ড দেন……”
সে অত্যন্ত করুন স্বরে করজোড় করার মতো করে বলল।
কিন্তু সেই কর্মচারীর চেহারায় যেন পরিস্কার লেখা ছিল যে, সে নিয়ম ভেঙে সিম দিতে পারবে না।
“আপনি এক কাজ করতে পারেন, আপনি এখান থেকেই ফোন করে জেনে নিতে পারেন।”
দোকানের কর্মাচারীটি সহমর্মিতা দেখিয়ে নিজের ফোনটা বাড়িয়ে দিলে সে তাড়াতাড়ি করে ফোনটা নিয়ে ওয়ালেট থেকে বহু পুরনো এবং ছেঁড়া একটি কাগজ বের করে তাতে লেখা নম্বরগুলো এক এক করে মোবাইলে ডায়াল করতে লাগল। তিন-চার জায়গায় ফোন করার পর সেই কাগজটা অতি যত্ন সহকারে এবং খুব সতর্কতার সাথে ভালোভাবে ভাঁজ করে অতঃপর কোন মূল্যবাণ বস্তুর ন্যায় সেটি আবার ওয়ালেটের এক সুরক্ষিত খোপে গুঁজে রেখে দিল, যেন সেটি নিরাপদে থাকে আর যেন কোথাও না পড়ে যায়।
দোকান থেকে বেরিয়ে সে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হল। ট্যাক্সিতে বসে তাঁর মাথায় বিভিন্ন ধরণের চিন্তা-ভাবনা ঘোরপাক খাচ্ছিল, সামান্য একখানা প্লাস্টিকের বস্তুর (আইকার্ড) সামনে তাঁর নিজেকে অনেক ছোট বলে মনে হচ্ছিল। মাত্র প্লাস্টিক-এর একটা টুকরো না থাকার কারণে আজ সে একটা সিমকার্ড পর্যন্ত নিতে পারল না।
হাসপাতালের কাছে এসে ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া দেওয়ার জন্য ওয়ালেট খুলে দেখল যে তাঁর কাছে শুধু মাত্র কুড়িটা টাকা পড়ে রয়েছে। ওয়ালেটে এটিএম কার্ড-এরও কোন হদিশ পাচ্ছেনা। ভালোভাবে ওয়ালেটের এদিক ওদিক দেখল, পেল না। সৌভাগ্যক্রমে প্যান্ট-এর পকেটে এটিএম কার্ডটি পেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়।
হাসপাতালের গেটের ঠিক ডান দিকেই ছিল এটিএম বুথ। কাঁচের দরজা ঠেলে এটিএম বুথের ভেতরে ঢুকল। অস্থির মস্তিস্কে টাকা তোলার সময় সে ভুল করে দু-দুবার এটিম পিন নম্বর ভুল ডায়াল করে বসে। তৃতীয়বার পিন নম্বর ঠিক হওয়ায় এটিএম মেশিন থেকে টাকা বের হওয়ার শব্দ কানে এলে সে একটু স্বস্তি পায়। কাগজের নোটগুলো হাতে নিয়ে গভীর দৃষ্টিতে চিন্তামগ্ন হয়ে কিছুক্ষণ ভাবতে থাকল – কাগজের এই টুকরো না থাকলে…… এমতবস্থায় বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা পরের ব্যক্তি আওয়াজ দিলে সে চমকে উঠে বাইরে বেরিয়ে হাসপাতালের দিকে পা বাড়ায়।
বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার উপক্রম, তখনও তাঁর হাতে টেস্ট রিপোর্ট ও মেডিক্যাল প্রেসক্রিপশনের কাগজ। সে খুব ভাল করেই জানত যে, এখন এই কাগজগুলোই তাঁর ভাইয়ের জীবন। যদি এই সমস্ত কাগজাদী না থাকে বা হারিয়ে যায়, তাহলে তাঁর ভাইয়ের চিকিৎসা মুশকিল হয়ে উঠবে। আর চিকিৎসা না হলে তাঁর ভাইকে বাঁচানো দুস্কর হয়ে যাবে।
সে ও তাঁর ছোট ভাই, দু’জনেই শহরের এক হস্টেলের আবাসিক। ছোট ভাই BTech ফাইনাল ইয়ার-এ পাঠরত আর সে নিজে MBA করার পর হন্য হয়ে চাকরির খোঁজ করছে।
গ্রামের বাড়িতে রয়েছে শুধু তাঁর মা ও বাবা। আজকাল তাঁর বাবাও এই সব কাগজের সমস্যায় জর্জরিত। জমি-জায়গার রেকর্ড ও দলীলের কাগজপত্র বের করার জন্য এক অফিস থেকে অন্য অফিসের কড়া নাড়ছে। আর তাঁর মা বাড়ির বাইরে সামনের দিকে একটুখানি জায়গায় সুন্দর রং-বেরঙ্গের ফুলে ভরা বাগানের দেখাশোনা করে বাড়ির আশেপাশের প্রকৃতিকে মনোরম করে তোলে। তাদের সকলের অস্তিত্ব যেন নির্ভর করেছিল যে, তাঁরা ভু-পৃষ্ঠের কোন অংশে বাসযোগ্য হবে।
ভাই-এর এক্সিডেন্ট হওয়ার খবর বাড়িতে সে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরেই তাঁর বাবা ও মা তাদের কলিজার টুকরোকে দেখতে হাসপাতালে পৌঁছায়। নিজের যুবক ছেলেকে এভাবে ভাঙা পায়ে হাসপালের বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে মায়ের চোখ অশ্রুধারার বাঁধ মানে না। বড় ছেলে মায়ের কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলে সে হস্টেলে নিজের রুমে এসে আইডি কার্ড খুঁজতে শুরু করল। পাগলের মতো আলমারি হাতড়াতে লাগল। তাঁর আইডি কার্ড আলমারির ড্রয়ারে পড়েছিল।
তাঁর কাছে এটা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল যে, শুধুমাত্র এই একটা কার্ড-এর ভরসায় পৃথিবীতে চলা বড় কঠিন। সে মনে মনে স্থীর করল, আমাকে বাকি সমস্ত ধরণের কাগজপত্র বানিয়ে নিতে হবে। যেন যে কোন জায়গায় খুব সহজেই নিজের পরিচয় পত্র হিসেবে উপস্থাপন করতে পারি। আমি সর্বপ্রথমে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও প্যান কার্ড বানাব। আর আমার সমস্ত কাগজপত্রের ফটো কপিও করে রাখব।
পরদিন সকালে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বাইকের চাবি হাতে নেওয়ার সময় তাঁর মনে পড়ল যে ড্রাইভিং লাইসেন্স বানাতে গেলে গাড়ির কাগজগুলো অবশ্যই লাগবে, আর সেগুলো না জানি ভাই কোথায় রেখেছে! সে হন্য হয়ে ভাইয়ের আলমারি তন্য তন্য করে খুঁজল কিন্তু কোত্থাও গাড়ির কাগজ পেল না। কাগজ না পেয়ে নিরুপায় হয়ে বাইকের চাবি ড্রয়ারে রেখে দিল। বিনা কাগজে গাড়ি নিয়ে বাইরে যাওয়া যাবে না। কারণ, গাড়ির কাগজ না থাকার কারণে ট্রাফিক পুলিশ ধরে চালান কাটবে। তাই সে বাধ্য হয়ে অটোতে যাওয়া শ্রেয় মনে করল।
হাসপাতালে পৌঁছে দেখল ভাইয়ের জ্ঞান ফিরেছে। ভাইকে অনেকটা সুস্থ দেখে সে অনেকটা শান্তনা পেল। মা ও ভাইয়ের জন্য নিয়ে আসা খাবারগুলো মায়ের হাতে দিয়ে ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসল।
কয়েকঘন্টা হাসপাতালে সময় কাটানোর পর সে হাসপাতালের ঠিক পেছেনের ছোট্ট পার্কে গিয়ে একটা বেঞ্চে শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে তাঁর মনে পড়তে লাগল যে, আজ কয়েক মাস ধরে সে এই বিভিন্ন ধরণের কাগজপত্রের জন্য এই অফিস সেই অফিস করছে। সে কেবলমাত্র এই আশায় রয়েছে যে, সে তাঁর ডিগ্রীর দৌলতে কোন না কোন না একদিন একটা ভাল চাকরি পেয়ে যাবে। শুয়ে শুয়ে তাঁর মাথায় আরো উল্টোপালটা সব চিন্তা-ভাবনা ঘোরপাক খাচ্ছে। সে ভাবছে, যদি আমার সার্টিফিকেট সমূহ হারিয়ে যায়……… তবে আমার কী হবে? তবে কী সেই সমস্ত কাগজ ছাড়া আমার কোন অস্ত্বিত্ব নেই?
সে ঘাবড়ে গিয়ে গা ঝেড়ে বেঞ্চ থেকে উঠে বসল। কিন্তু মাটির দিকে তাকাতেই সে আরো বিস্মিত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগে যে মাটিতে সবুজ ঘাস দেখেছিল কৌতুহলবশত সেই মাটিতেই এখন যেন ঘাস না হয়ে কি যেন সাদা সাদা ছড়িয়ে রয়েছে। খুব ভালোভাবে লক্ষ করে দেখল যে সেই ছড়িয়ে থাকা শুভ্রতা আসলে কাগজের শুভ্রতা। পা দিয়ে মাটিতে জোর দিতেই জুতোর নীচে কাগজ ছিঁড়ে যাওয়ার ‘চিররর…’ শব্দ এলো। নিঃসন্দেহে ভূ-পৃষ্ঠে যেন মাটির পরিবর্তে কাগজ ছিল যা পায়ের চাপ দেওয়ার ফলে ছিঁড়ে গিয়েছে। ঠিক সেই মূহুর্তেই একটা দমকা হাওয়া এলে সে হতভম্ব হয়ে দেখল যে, তাঁর সামনে দণ্ডায়মান ৬ তলা হাসপাতালের বিল্ডিংটাও দুলে উঠেছে। দু হাত দিয়ে ভালোভাবে চোখ দুটো ঘষে দেখল, ইট-বালি-পাথর দিয়ে নির্মিত দেওয়ালও যেন কাগজের। স্তম্ভিত হয়ে চারিদিক দেখতে লাগল। তাঁর চারপাশে সবকিছু যেন শুধু কাগজ আর কাগজই ছিল।
ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে সে দু’হাত দিয়ে নিজের মুখ মুছতে গিয়ে আরো চমকে উঠল। তাঁর দু’হাত যেন এক অদ্ভুত স্পর্শের অনুভব করে। ঘাবড়ে গিয়ে দ্বিতীয়বার মুখের উপর দু’হাত ঘোরাতে গিয়ে আশ্চর্য্য হয়ে দেখল যে তাঁর চেহারার মাংসগুলো একটাও নেই, আর হাড়গুলো যেন কাগজ দিয়ে মোড়া। ভয়ে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাত দুটো মুখ থেকে টেনে নেয়। নিজের হাতের দিকে তাকাতেই দু’চোখ যেন ছিটকে বেরিয়ে আসারা উপক্রম। তাঁর হাতও যেন চামড়ার পরিবর্তে কাগজ দিয়ে মোড়ানো। আর সেই কাগজগুলো তাঁর কাছে অতি পরিচিত। ভালোভাবে কব্জি ঘুরিয়ে দেখতেই সে জোরে চেঁচিয়ে উঠল –
“আমার সার্টিফিকেট……………… আমার চাকরী……………
হায় আমার ক্যারিয়্যার……………… কী হবে আমার ভবিষ্যত…………?”
কিছুক্ষণ পর আবার মনে হল যেন তাঁর কোমরের উপর সজোরে এক অদৃশ্য চাপ পড়ল আর সে এক শাহী দরবারে নিজের মাংসবিহীন হাড়গুলোর উপর কাগজের পোষাক পরিধান করে অভ্যর্থনামূলক সালাম প্রদানের জন্য ঝুঁকে আছে। সে যেন সে কয়েক যুগ ধরে এভাবে হাঁটুতে হাত দিয়ে রুকু অবস্থায় (ঝুঁকে) আছে।।
মতামত দিন