
যীশুকে নিয়ে একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কথা
শুভাশীষ পাল
যীশুকে নিয়ে কিছু কথা
-------------------------------------------------
আমি আদ্যপান্ত সনাতন,
হিন্দু ঘরের লাল।
আমার ঘরে একটা বুদ্ধ আছে,
আর একটা মেরীর দুলাল।
না না কোনো বিশেষ কবির কবিতার লাইন নয়, এ আমার ঘরের ছবি। শুরুর দিনে অর্থাৎ জ্ঞান পড়ার দিন থেকে স্বরস্বতী পূজায় উপোস করে পুষ্পাঞ্জলি দেই, কালি পূজায় জ্বালাই মোমবাতি, লক্ষ্মী পূজার সন্ধ্যায় মায়ের হাতের নারকেল নাড়ু, ছোলা-মটর ভাজা না খেয়ে পাড়ার মন্ডপে পা রাখিনা।
এর পরেও আমার অস্থিমজ্জায় তেত্রিশ কোটির ভীত ভীষণ রূপে মজবুত হয়নি কেনো, সে আমি বলতে পারবোনা। এটুকু বলতে পারি, আমার ঘরে দু’জন ঈশ্বর বাস করেন তারা একজন ধ্যানরত গৌতম বুদ্ধ, অন্যজন প্রভু যীশু, মেরীর দুলাল।
আমি রক্ত মাংসের অস্তিত্বে ভীষণ রকম বিশ্বাসী। অহংকারে অভিমানী, রাগে বীর্যত্বেজি, ভালোবাসায় ভীষণ অদূরে এমন চরিত্রে একাত্ম অনুভব করি। মোহিনী নারীমূর্তি কিংবা মোহন বাঁশীর সনাতনী পুরুষ আমাকে তাৎক্ষণিক নাড়া দিলেও, নতুন কেনা ধুপদানিটার গোল গোল ধূমায়িত ধোঁয়া আমার ঘরের যে প্রতিরূপে পৌঁছায় তাঁরা কেউই তেত্রিশ কোটির মধ্যেকার নয়।
আমার এক কমিউনিস্ট বান্ধবী ছিল। যে কিনা আদ্যপান্ত দেবী স্বরস্বতীর ভক্ত। মায়ের পা ধোয়া জল খাওয়ার কথা বলতে শুনেছি তাকে, তবে তা কেবল ফাইনাল পরীক্ষার আগে। তার কথা মনে পড়লে আমার আজকালকার বাংলার কমিউনিস্ট নেতাদের কথা খুব মনে পড়ে। তারা না আত্মিকরণ করতে পেরেছে নিরিশ্বরবাদী কমিউনিজমকে, না হতে পেরেছে প্রকৃত ঈশ্বর বিশ্বাসী। আমিতো কোনোটাই নই, তাই ফাঁকা মাঠে কেবল প্রশ্ন রেখে যাই। আমি বুদ্ধের ধ্যানে বিশ্বাসী আর খ্রিস্টের পৌরুষত্বে। তাই পঁচিশে ডিসেম্বর আমার কাছে এক অন্য মাত্রা নিয়ে আসে, নিয়ে আসে রোমাঞ্চ।
আমি প্রার্থনাশীল জীবনে বিশ্বাসী। আর এই জায়গায় বুদ্ধ ও যীশু অনন্যতার ছাপ রেখে যায় আমার অস্তিত্বে। আজ পঁচিশে ডিসেম্বর। তাই যীশুর কথা একটু বলি।
আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। আমরা মাইকেল মধুসূদন সম্মধ্যে একটা কথা বলে থাকি, তিনি সাত বছরের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের সত্তর বছরের ইতিহাস এগিয়ে দিয়েছেন। একই কোড একটু উল্টে-পাল্টে আমরা বলতে পারি প্রভু যীশু মাত্র সাড়ে তিন বছরে তেত্রিশ কোটি প্রজন্মকে এক বীর্য্যতেজী পৌরুষত্বের মন্ত্রে দীক্ষিত করে গেছেন।
তার হাজারো অলৌকিক কর্মকান্ড নিয়ে খ্রিস্ট ধর্মালম্বীরা আলোচনা করুক, তর্ক করুক। আমার অন্তরের বিশ্বাসে তাঁর এ সকল কর্মকান্ডের নেপথ্যে ছিল তার প্রার্থনাশীল জীবন। আপনি যদি মর্তমানবের সেবায় নিয়োজিত হতে চান তাহলে আদ্যপান্ত আপনাকে প্রার্থনাশীল জীবন-যাপন করতে হবে।
আমাদের চারপাশে যত রক্তমাংসের সন্তদের দেখি তাঁরা প্রচার করতে ভালোবাসেন, গলা ছেড়ে আত্মগান গাইতে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন আপন মন্ত্রে দীক্ষা দিতে। কিন্তু প্রার্থনার ক্ষেত্র থেকে তাঁরা শতহস্ত দূরে থাকেন। এখানেই আমার বুদ্ধ-খ্রিস্ট অনন্য।
আমার উপলব্ধিতে এই প্রার্থনা বিষয়টা অস্ত্রে শান দেওয়ার মতো। এক্ষেত্রে ধর্মের মন্ত্রে, আত্মার অস্ত্রে শান দিয়ে ধর্মাচরণ করা।
আমার স্কুল জীবনের বন্ধু গৌরাঙ্গ। সদ্য রাজনীতিতে প্রবেশ করেই ‘বি.জে.পি.’র মন্ডল সভাপতির পদ পেয়েছে। সে ব্যাটা দেখা হলেই আজকাল আমার অস্থি-মজ্জায় হিন্দুত্বের বীজ রোপণ করতে উঠে পড়ে লাগে, সে এক প্রকার জোরপূর্বক। তার বক্তৃতায় আমার রক্ত ফুটতেও শুরু করে। নিজেকে অভাগা মনে হয়। আমি খুব একটা বিরক্ত হইনা, সেও ধার্মিক হতে চেষ্টা করে, ইষ্ঠ লাভের ইচ্ছায় তার ভক্তি, কেবল তার আমার পথটাই আলাদা। সে সাভারকারের উগ্র হিন্ধুত্বে বিশ্বাস করে আমার বিশ্বাস স্বামীজিতে। আর তাই আমার ঘরে বুদ্ধ-যীশু, তার ঘরে ‘মোদী’।
আমি গ্রামে জন্মেছি। পড়াশোনা ও কর্ম সূত্রে মফস্বল শহর সোনারপুরে থাকি। কৈশর কেটেছে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে দ্বারিকনগরে। মনে পড়ে ছোট বেলাকার পঁচিশে ডিসেম্বর পালনের দিনগুলির কথা। আমরা সাইকেল নিয়ে দল বেঁধে হই হই করতে করতে বকখালী সমুদ্র সৈকতে চড়ুইভাতি করতে যেতাম। পঁচিশ কিমি পথ। সাইকেলের হ্যান্ডেল হাঁড়ি, কড়া, বাজার হাট ঝুলতো। ভোর বেলায় কুয়াশা ঘেরা ১১৭-নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে ছুটত আমাদের সাইকেল। পৌছিয়ে বড়রা রান্নাবান্না করতো আমরা যেতাম সৈকতের স্বাদ নিতে। দুপুরে কব্জি ডুবিয়ে মাংস-ভাত।
বিকেল গড়িয়ে গোধূলির সূর্য্য যখন দেখা দিত, এক আকাশ ক্লান্তি নিয়ে সেই পঁচিশ মাইল পথ পেরিয়ে আসতাম বাবার পুরোনো সাইকেলে চেপে। নিমাই দা গান ধরতো। লালনের গান। উত্তরের ফুরফুরে হওয়ায় বাড়ির গরম বিছানা বালিশের আবেশে সাইকেলের প্যাডেল আরো জোরে ক্যাচ-কোচ আওয়াজ উঠতো। আমার বিশ্বাস এও এক ধরনের ধর্মাচরণ। এও এক প্রকার প্রার্থনা। যেখানে সুখানুভূতির সঙ্গে মিলিত হই, আত্মার সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ হয়।
বুদ্ধ পূর্ণিমাতেও অনুরূপ অনুভূতির হাজারো স্মৃতি ভেসে ওঠে। সে না হয় আর এক দিন বলবো। এই লেখা যখন লিখছি, বসে আছি একাকী আমি। আর আমার চোখের সম্মুখে শোভা পাচ্ছে দু’জন রক্তমাংসের মহান ঋষি গৌতম বুদ্ধ ও প্রভু যীশু। আমার প্রনম্ম।।
মতামত দিন