
ছোটগল্পঃ ঘন্টাবাবা
গল্পকারঃ রাবীয়া সালীম মির্জা
অনুবাদকঃ মোজাহিদুল ইসলাম
ঘন্টাবাবা
---------------------------------------------------
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন এই কাগজের নোট-এর প্রচলন ছিল না। নিজের গরুর গাড়ি নিয়ে এক ফেরিওয়ালা গ্রামে প্রবেশ করল। গরু ধীর গতিতে চলছিল আর গরুর গলায় বেঁধে রাখা টুন-টুন ঘন্টা গ্রামবাসীদের কাছে তাঁর আগমনের খবর দিচ্ছিল। গ্রামবাসীরা অনেকেই তাদের পুরনো জামা-কাপড়, বাসন-পত্র বা কেউ ফসলাদির বিনিময়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করত। সকলেই তাঁকে ঘণ্টা বাবা বলেই ডাকত।
ঘণ্টা বাবার বাসন-পত্রের একটা আলাদাই বৈশিষ্ট ছিল এবং টেকসইও হত বহুদিন।
শেখ-এর স্ত্রী কয়েকদিন ধরেই বাড়ির পুরনো, অপ্রয়োজনীয় এবং ভেঙে যাওয়া জিনিসপত্রগুলো একত্রিত করে সেই ফেরিওয়ালার অপেক্ষায় ছিল। ঘন্টার আওয়াজ শুনে দৌড়ে এসে ফেরিওয়ালাকে আওয়াজ দিলেন। ঘন্টা বাবা নিজের গরুর গাড়ি থামাতেই শেখ-এর স্ত্রী ভেতর থেকে জমা করা জিনিসপত্রের পুটলিটা দরজায় এনে রেখে দিয়ে বললেন, বাবা এই পুরনো বাসনগুলোর পরিবর্তে আমাকে কিছু নতুন বাসন দিন।
বাবা হেসে মাথা নাড়লেন – “কী নেবে মা”?
শেখ-এর স্ত্রী পুরো গরুর গাড়ির উপর দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখলেন যে, প্রায় সব বাসনগুলোই খুব সুন্দর এবং পছন্দনীয়। একটু ভালো করে দেখেশুনে কয়েকটি থালা এবং বাটি পছন্দ করলেন অতঃপর ঘণ্টা বাবা তাঁকে দোআ দিলেন – “সুখী হও, সংসারে বরকত আসুক।” বলে বাবা সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
শেখ-এর স্ত্রী খুব আনন্দের সাথে খাবার রান্না করে নতুন পাত্রে করে শেখ-কে খাবার পরিবেশন করলেন। দুজনে পেট পুরে খেলেন আবার খাবার বেচেও গেল। খাওয়ার শেষে থালা-বাসন মাজতে শুরু করে শেখ-এর স্ত্রী বাটিতে একটু জোরে ঘোষে দিলে সেখান থেকে একটা সাদা ধোঁয়া বেরিয়ে এলো যেটা একটা জ্বীন এর রূপ ধারণ করল।
“হে আমার প্রভু আমার জন্য কী আদেশ?”
দুজনে ভয়ে পেয়ে গেলেন।
শেখ বললেনঃ “তুমি কে?”
“আমি শুমান, এই বাটির জ্বীন, আমাকে যা আদেশ করবেন আমি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সে আদেশ পালন করব”
শেখ-এর স্ত্রী যেমন আশ্চর্য হয়েছিলেন তেমনই আনন্দও। শেখ-এর স্ত্রী থালা-বাটি সব ছেড়ে এক লাফে গিয়ে খাটে শুয়ে পড়লেন আর বললেনঃ
“হে শুমান! সমস্ত বাসনপত্র মেজে পরিস্কার করে দাও এবং বাড়ি-ঘর ঝেড়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখবে আর হ্যাঁ সকালে, আমার ওঠার আগেই আমাদের জন্য সুস্বাদু নাস্তা বানিয়ে রাখবে।”
“যা হুকুম আমার মালিক”
শুমান কয়েক মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত কাজ সম্পন্ন করল এবং শেখ-এর স্ত্রীর সেবা যত্নও করছিল। এ সব দেখে শেখ বেশ মজা পাচ্ছিল। তারা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল বেশ মজাদার নাস্তা তৈরি আছে যা তাঁরা অনেক আনন্দের সঙ্গে খেল। শুমান সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ির সমস্ত কাজ করেছে, কাপড় পরিস্কার করেছে এমনকি জঙ্গল থেকে কাঠও কেটে এনেছে। শেখ-এর স্ত্রী কখনো জঙ্গল থেকে ফল আনতে বলত বা কখনও মন খারাপ হলে বলত আমাকে নেচে দেখাও।
ধীরে ধীরে জ্বীন ক্লান্ত হতে শুরু করল। সে ভাবতে লাগল যে, আমি কোন ফাঁদে এসে ফেঁসে গেলাম রে বাবা। সেখ-এর স্ত্রীর উপর সে অত্যন্ত রেগে ছিল, এখন কোন কাজ করতে বললে শুমান বিড়বিড় করত।
শেখ জ্বীনের এই দুরাবস্থা দেখে তাঁকে আরো রাগাতো আর বলতঃ “তুমি জ্বীন হয়েও এমন কাজ করছ, আর আমার স্ত্রীকে আরো অলস ও মোটা-সোটা করে দিয়েছ, আগে সে হাল্কা-পাতলা ছিমছাম শরীরের সুন্দরী মহিলা ছিল। এখন সে চিড়চিড়ে মেজাজের আর ঝোগড়াটে হয়ে গিয়েছে।”
“আমার মালিক, আমি আপনারও কাজ করে দেব, আপনি আদেশ তো করুন।” জ্বীন শেখকে খুব পছন্দ করত।
“না থাক, ধন্যবাদ, আমি আমার কাজ নিজে হাতে করতে অভ্যস্ত।”
একদিন হঠাৎ শুমান কাঁদতে কাঁদতে শেখকে এসে বললঃ
“আমার মালিক, আমি অত্যন্ত অসহায়, আমারও স্ত্রী-সন্তান আছে। কয়েকবছর হয়ে গেল তাদের দেখিনি।
আমার কোনো এক ভুলের কারণে ঘণ্টা বাবা আমাকে এই বাটির মধ্যে বন্দি করে রেখেছিল, যদি দয়া করে আপনি এটা ভেঙে দেন তবে আমি মুক্ত হয়ে যাব।”
শেখ বললেন, আমি একটা শর্তে তোমাকে মুক্তি দিতে পারি, তুমি কোনো দিন কাউকে কষ্ট দেবে না বরং অসহায় এবং অসুবিধায় থাকা মানুষদের সাহায্য করবে।
জ্বীন শেখকে প্রতিশ্রুতি দিলে শেখ বাটিটি ভেঙে দেয় আর তৎক্ষণাৎ জ্বীন অদৃশ্য হয়ে যায়।
এই কীর্তিকলাপের ফলে শেখ-এর স্ত্রী শেখ এর প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়েন। শেখ তাঁর স্ত্রীকে বোঝালেন যে আমার কাছেও একটি জ্বীন আছে এমনকি তোমার কাছেও আছে। তুমি যদি একটু পরিশ্রম করে মন দিয়ে কাজ করো তবে তুমিও সুখে থাকবে, আনন্দে থাকবে। আর অন্যরাও তোমাকে দেখে, তোমার পরিশ্রম দেখে তাঁরাও পরিশ্রমী হয়ে উঠবে। তুমি নিজে সুখে থাকবে, অন্যরা তোমার প্রশংসাও করবে।
শেখ-এর স্ত্রীর কাছে তাঁর কথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে আবার পূর্বের ন্যায় পরিশ্রমী ও স্মার্ট হয়ে উঠল।
শেখ খুশি ছিল সেও খুশি।।
মতামত দিন