
জ্ঞান-ই শক্তি
আমিনুল হক জাহাঙ্গীর
জ্ঞান-ই শক্তি
------------------------------------------------
কোথায় যেনো পড়েছি কিংবা শুনেছি ঠিক মনে করতে পারছিনা। স্মরন শক্তি কমে গেছে। একটা বিষয় ভাবতে ভাবতে আরেকটা টপিকে ঢুকে পড়ি। তখন আগেরটা আর মনে থাকেনা। যাক সে কথা। যা বলছিলাম, কোথাও পড়েছি যে বঙ্কিম চন্দ্র নাকি ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহোদয়ের ডাইরেক্ট ছাত্র ছিলেন। কিন্তু বঙ্কিম তার উস্তাদকে পছন্দ করতেন না। কেন? বি.এ পরীক্ষায় তিনি বাংলায় ফেল করেছিলেন। তার ধারনা উস্তাদজি তাকে ফেল মার্ক দিয়েছেন ইচ্ছা করেই। তো যে প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে বঙ্কিম বাংলায় ফেল করেছিলেন সেই প্রশ্নটি আজও সংরক্ষিত আছে। মজার বিষয় হলো আমাদের আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ স্যার ঐ প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা দিয়ে ১৬ নম্বর পেয়েছেন। ভাবা যায়? কত কঠিন প্রশ্ন করেছিলেন বিদ্যাসাগরজি!!
আমি বুঝতে পারিনা তিনি কি এমন বিদ্যা অর্জন করেছিলেন যে তাকে এমন একটা উপাধি দেওয়া হয়েছিল। কয়টা ভাষা তিনি শিখেছিলেন? আমাদের ডঃ মোঃ শহীদুল্লাহ স্যার সতেরোটি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তাকে তো বিদ্যা মহাসাগর উপাধি দেওয়া হলোনা। ভারতের কোন এক ভদ্রলোক রামচরণ না কি জানি নাম, যিনি ষোলটি বিষয়ে মাষ্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেছেন তাকেও দেওয়া হয়নি এমন উপাধি। এছাড়া তদানিন্তন এই উপমহাদেশে কি এমন বিদ্যা চর্চার সুযোগ ছিল যে কাউকে বিদ্যার সাগর উপাধি দিয়ে দেওয়া যায়? আসলে তাকে বিদ্যার পরিমান দিয়ে নয়, বিদ্যার প্রতি অসামান্য আগ্রহ আর আসক্তির কারণেই তাকে এমন উপাধি দিতে হয়েছিল। এছাড়া বিধবা বিবাহ সহ আরো কিছু বিষয়ে তার অবদান আজো এই উপমহাদেশে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। সকল মহলেই তিনি প্রশংসিত। কিন্তু ফেল করা বঙ্কিম নাকি বাংলা উপন্যাসের জনক। তার অনেক বিখ্যাত উপন্যাস আছে যা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। কেন লোকজন বি.এ ফেল করা একজন ভদ্রলোকের লেখা পড়ে ডিগ্রী অর্জন করে? উত্তরটা খুব সোজা। ডিগ্রী কখনও জ্ঞানের মাপ কাঠি হতে পারেনা, হয়না। জ্ঞান অর্জন করতে হয় বই পড়ে, চিন্তা করে, অনুসন্ধান করে, গবেষণা করে, বিতরন করে, আলোচনা পর্যালোচনা করে। জ্ঞানের জগতে বিচরণ করে। কোন অবস্থাতেই ডিগ্রী বা পুরষ্কার অর্জন করে নয়।
আমাদের অনেক ডাঃ আছেন যারা নামের সাথে এ টু জেড অসংখ্য ডিগ্রীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে দেন। সেই সব ডিগ্রী দেখে রোগীরা মুগ্ধ হয়। সেখানে ভীড় করে। এখন আর এমবিবিএস ডিগ্রী রোগীকে আকর্ষণ করেনা। অথচ ছোট বেলায় আমার বাবাকে দেখতাম অনেক রোগীকে সামলাতে। শুধু পালস্, চোখ, জিহবা আর মুখের রঙ দেখে রোগ নির্ণয় করে ঔষধ দিতেন। কোন টেস্ট দিতেন না। রোগীকে কিছু প্রশ্ন করতেন। তাদের সাহস ও শান্ত্বনা দিতেন। ঔষধ অপেক্ষা পথ্যের কথা বলতেন বেশী। কচু, লতা, বেগুন, টমেটো, শাক, ফলমূল, ছোট মাছ, মুরগীর বাচ্চা, ডিম, কবুতরের বাচ্চা, গাভীর বা বকরির দুধ পান করতে বলতেন বেশী। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে উপদেশ দিতেন। রোগীদের সাথে হাসি মশকরা করতেন। তার আচরণে রোগী অর্ধেক ভাল হয়ে যেতো। তাছাড়া বলতে গেলে বিনা পয়সাতেই রোগী চিকিৎসা পেতো। ডাঃ এর ভিজিট, টেস্টের নামে বিলাসিতা এই সবের কোন টেনশন তখন ছিলনা। আমি তার চিকিৎসা পদ্ধতি পর্যবেক্ষন করতাম। আসলেই তিনি ছিলেন অসাধারণ এবং সফল একজন চিকিৎসক। যদিও তার ছিলনা বড় কোন ডিগ্রী। অতি সাধারন একজন ফার্মাসিষ্ট। কিন্তু তার ঔষধ সম্পর্কে ভাল জানা শুনা ছিলো। রোগের লক্ষন, এবং ঔষধের ডোজ ইত্যাদি বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা ছিলো তার। মৃত্যুর আশংকায় উদ্বিগ্ন অনেক রোগীকে তার চিকিৎসায় সুস্থ হতে দেখেছি যারা দীর্ঘ দিন বড় বড় ডিগ্রীধারী ডাঃদের চিকিৎসা নিয়ে সর্ব হারা হয়েছিলেন। আজও এলাকায় কোথাও বেড়াতে গেলে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ বাবাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। আমাকেও অনেক সম্মান করে। আপ্যায়িতও করে। তার শূন্যতা অনুভব করে নিরবে চোখ মুছে, আমি অভিভুত হই। আমার চোখে অতি সাধারন একজন মানুষ তখন মহামানব হয়ে উঠেন। আমার সব মামা খালারা আব্বার চিকিৎসা নিয়েছেন। বলতে গেলে নিয়মিতই নিতেন। তারাও সব সময় খুব প্রশংসা করতেন বা করেন।
আমার এখনও মনে পড়ে, বাবার সাথে নানু বাড়ী বেড়াতে গেলে খালা আর মামীরা আব্বাকে ঘিরে ধরতেন। অসুখ না থাকলেও মজা করতে মিছামিছি রোগী সাজতেন। আম্মারা ছিলেন আট বোন। সবাই বেচে আছেন। আম্মা সবার বড়। সেই হিসেবে আব্বার সাত জন শ্যালিকা আর পাঁচ জন শ্যালক। সবাইকে নিয়ে অনেক আনন্দ ফুর্ত্তি করতেন। মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে সবাই বেসামাল হয়ে যেতেন। যারা আড্ডায় আসতে পারতোনা কর্ম ব্যস্থতার কারনে তারাও তফাৎ থেকে শামিল হতো, “অত আসাআসি কিসের, আমরাও আইতাছি” বলে হাসতে থাকতো।
আগের দিন বাঘে খাইছে। কেবল এই কথাটিই চরম সত্য নয়। আরো চরম সত্য হলো আগের সব ভালো জিনিস গুলোও বাঘে খাইয়া ফেলেছে। এই বাঘ এলো কোন বন থেকে? না কোন বন থেকে নয় এসেছে বড় বড় ডিগ্রীর কারখানা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যে যত বড় শিক্ষিত সে তত স্মার্ট, তত চালাক, তত বড় প্র....।
তার প্রমাণ সকলের চোখের সামনেই আছে। অল্প কিছু ব্যতিক্রম হয়তো আছে। কি আসে যায় তাতে? দুই একটা গরু হয়তো দুধ দেয়। বাকি সব ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে। আমি আমার সন্তান ও অনুসারিদের ডিগ্রীর পিছনে নয় জ্ঞানের পিছনে ছুটতে দিয়েছি। কারন, Knowledge is power, জ্ঞানই শক্তি।
মতামত দিন