
ছোটগল্পঃ ভুল (প্রথম পর্ব)
লেখকঃ মুহাম্মদ ফারহান ইসলাম নীল
ভুল
---------------------------------------------------------------------
“বিয়ের আগে খুব বলেছিলে আমারে হাতি কিনে দিবে, ঘোড়া কিনে দিবে আর এখন একটি নীল শাড়িও কিনে দিতে পারো না। কেমন জামাই তুমি হুম ?”
একটু খিটখিটে মেজাজ নিয়ে মর্জিনা কথাগুলো তার পঙ্গু স্বামী নজরুলকে বললো। নজরুল মর্জিনার সাথে দুই বছর প্রেম করার পর পালিয়ে বিয়ে করে। কারণ দুজনের পরিবার তাদের সম্পর্ক মেনে নিবে না। তাই বাধ্য হয়ে দুজনকে ঘর ছাড়তে হয়।
বিয়ের আগে নজরুল মর্জিনাকে অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখিয়েছিল। মর্জিনাও নজরুলের প্রেমে অন্ধ হয়ে সব বিশ্বাস করেছিল। তাই তো বাবার বিশাল অট্টলিকা ছেড়ে নজরুলের মতো মধ্যবিত্ত একটা ছেলের হাত ধরে গ্রাম ছেড়েছে, ছেড়ে জন্মদাতা মা-বাবাকে। সম্পর্কছিন্ন করেছে আদরের ছোট এবং বড় ভাইকে। শুধু ভালোবাসার মানুষটার বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর সুখটা নেওয়ার জন্য। মর্জিনা সোনার পালঙ্ক ছেড়ে বেছে নিয়েছে শিমুল কাঠের চৌকি। যাকে বলা হয় সুখে থাকতে ভুতে কিলায় এমনটা নয় নজরুলও কম ভালোবাসতো না মর্জিনাকে। মাত্র পাঁচশত টাকা নিয়ে মর্জিনার হাত ধরে সেই নওগাঁ জেলার মফস্বল গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে চলে আসে।
শুরু করে ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে নতুন জীবন। শুরু হয় মা-বাবাকে ছেড়ে নতুন সংসার। এই শহরে নজরুলের পরিচিত কেউ নেই। হাতে মাত্র পাঁচশত টাকা। দুজন মানুষ খেতে হবে এবং থাকতে হবে। যতদিন না পরিবেশ শান্ত না হয়। নজরুল জানে ওর মা-বাবা ওকে খুঁজবে না। কিন্তু মর্জিনার বাবা তো বাংলা সিনেমার ভিলেনদের মতো কলিজার টুকরা মেয়েকে খুঁজতে পাতাল অব্দি যাবে। নজরুল যদি মহিদুল খানের হাতে ধরা খেয়ে যায় তাহলে সারাজীবন জেলের ঘানি টানতে হবে। এবং জেলের ভিতরেই পঁচে মরতে হবে।
নজরুল ভাবতে থাকে কি করলে ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে সুখে থাকা যাবে? যদিও মা, বাবার জন্য মন কাঁদছে। কিন্তু কিছু করার নেই। একবার ঘর ছেড়েছে বদনাম হয়েছে আর ঘরে ফিরবে না। মর্জিনাকে নিয়েই এই শহরে বাকী জীবন কাটিয়ে দিবে।
দুজনের হাতে দুটি ব্যাগ। নজরুল এক হাতে ধরেছে আরেক হাত দিয়ে মর্জিনাকে ধরেছে। দুজন রাস্তা দিয়ে হাটছে। গন্তব্য কোথায় জানে না। কার কাছে থাকবে এটাও জানে না। কোথায় একটু মাথা গুজবে সেটাও জানা নেই।
মাথার উপর সূর্য। সূর্যের তাপও প্রখর। যেন মনে হচ্ছে সূর্যটা মাথার তিন হাত উপর। গরমের চোটে মর্জিনা ঘেমে জুবুথুবু হয়ে গেছে। কপাল ঘেমে টুপটুপ করে ঘাম পড়ছে।
নজরুল মর্জিনার মুখের দিকে তাকিয়ে মর্মাহত হয়। মনে মনে ভাবে, আমার মধ্যে মর্জিনা কী দেখেছিল যে, বাবার অট্টলিকা ছেড়ে পালিয়ে আসলো? শুধু কী ভালোবাসার টানে আমার হাত ধরে চলে আসলো নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
মর্জিনার গলা শুকিয়ে গেছে। হাটতে হাটতে পায়ে ব্যাথা ধরেছে। তারপরও দুজন হেটেই চলছে। মর্জিনা বলারও সাহস পাচ্ছে না ওর তৃষ্ণা লেগেছে। নজরুলও বেশ ক্লান্ত। একটি চায়ের দোকানে গিয়ে বসে এবং দুটি রুটি আর দুটি কলা কিনে নিয়ে দুজনে খায়।
দুজনে কিছুক্ষন বসে থাকে। নজরুল মনে মনে ভাবে এভাবে হাটতে থাকলে দিন শেষে রাত আসবে তবুও হাটা শেষ হবে না। আপাতত একটি থাকার জায়গা খুঁজে বের করতে হবে।
নজরুল বুকে সাহস নিয়ে চায়ের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে, ভাই এখানে বাসা ভাড়া পাওয়া যাবে?
“হ ভাই যাবো। তয় আপনেরা কই থিকা আইছেন?”
“ভাই আমাদের বাড়ি নওগাঁ জেলায়।”
“এইহানে আপনে গো পরিচিত কেউ আছেনি?”
“না ভাই, আমাদের এখানে পরিচিত কেউ নাই।”
“সে কী আপনের বউ লাগেনি?”
চা দোকানদারের কথা শুনে নজরুলের গলা শুকিয়ে যায়। কারণ নজরুল এখনো বিয়ে করেনি। তাই কী উত্তর দিবে ভেবে পায় না। কিছুক্ষন চুপ থাকার পর বলে, হুম ভাই। সে আমার স্ত্রী।
“চাকুরী বাকুরীর ব্যবস্থা করছেন?”
“ভাই চাকুরী করার জন্যই এসেছি। আগে একটা থাকার ব্যবস্থা হোক তারপর চাকুরী খুঁজে নিবো। আপনি শুধু বলে দিন কোথায় গেলে বাসা ভাড়া পাবো?”
দোকানদার একটি ভিজিটিং কার্ড হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, মজিদ ভাইয়ের বাড়ি আপনে গো নওগাঁয়। সে নওগাঁর মানষের উপকার করে। এই নাম্বারে কল দেন একটা ব্যবস্থা কইরা দিবো।
নজরুল কার্ডটি হাতে নিয়ে মজিদের নাম্বারে কল দিয়ে কথা বলে। মজিদ নজরুলকে শিমুলতলা যেতে বলে। নজরুল দোকানদারকে বলে, ভাই এখান থেকে শিমুলতলা কতদুর?
“ভাই রিক্সাতে যাইতে দশ মিনিট লাগবো।”
নজরুল রুটি কলার দাম দিয়ে রিক্সা নিয়ে শিমুলতলা চলে যায়। শিমুলতলায় আনোয়ার হোসেনের মুদি দোকানে মজিদ বসে ছিল। নজরুল শিমুলতলা নেমে মজিদকে কল দেয়। মজিদ দুজনে সাথে নিয়ে একটি বাসায় যায়।
নজরুলের কাছে সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো ঘটছিল। মর্জিনার খুব ভয় হচ্ছিল। চেনা নেই জানা নেই অচেনা একটি মানুষের পিছে হাটছে। ভয়ে মর্জিনার গলা শুকিয়ে গেছে। পানি চাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। যে মর্জিনা ভালোবাসার টানে ঘর ছেড়েছে সেই মর্জিনা এখন ভীতুর ডিম। ভয়ে মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে। গলায় পানি না দিলে মরে যাবে যাবে ভাব। বুকে সাহস নিয়ে নজরুলকে বলে, আমি পানি খাবো।
মর্জিনার পানি খাবো শুনে মজিদ একটি পিচ্চি মেয়েকে পানি আনতে বলে। কিছুক্ষণ পর পিচ্চি মেয়ে পানি নিয়ে হাজির হয়।
মজিদ নজরুলের কাছে ঘর পালানোর কথা শুনতে চায়।
নজরুল কিছু না লুকিয়ে পুরো ঘটনা বলে দেয়।
নজরুল আর মর্জিনার প্রেমের কাহিনী শুনে মজিদ কেঁদে ফেলে। এবং বলে, তুমি আমার এলাকার ছোট ভাই। আজ থেকে তুমি এই বাসায় থাকবে। তোমাদের দুজনের চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিবো। তবে হ্যাঁ, মর্জিনাকে সারাজীবন সুখের রাখবে। মর্জিনা তোমাকে ভালোবাসে বলেই বাবার ধন-সম্পদ ছেড়ে এসেছে। মনের ভুলেও মর্জিনাকে কষ্ট দিও না। চাকুরী না পাওয়া পর্যন্ত যতো টাকা লাগে আমার কাছে থেকে নিও।
মজিদের কথা শুনে নজরুল কেঁদে ফেলে এবং মজিদকে জড়িয়ে ধরে। মজিদ নজরুলকে সান্তনা দেয়।
“ভাই আমরা কিন্তু এখনো বিয়ে করিনি।”
মজিদ বলে, সমস্যা নেই তোমরা দুজন রেস্ট করো। সন্ধ্যার সময় কাজী ডেকে তোমাদের বিয়ে দিবো। মজিদ পকেটে থেকে দুই হাজার টাকা বের করে নজরুলের হাতে দিয়ে বলে, শিমুলতলায় গিয়ে সংসারের যাবতীয় জিনিষপত্র কিনে এনে রুম সাজাও।
আমি সন্ধ্যায় ফিরে আসবো। মজিদ চলে যায়।
রুমটা কেমন যেন অপরিস্কার। পিচ্চি মেয়েটা ঝাড়ু এনে রুমটা পরিস্কার করে দেয়। নজরুল অবাক হয়ে মজিদের উদারতার কথা ভাবে। চেনা নেই জানা নেই শুধুমাত্র একই জেলার মানুষ বলেই মজিদ ভাই আমাদের এতো বড় উপকার করলো? আজকাল নিজের ভাইও এমন উপকার করে না।
সন্ধ্যার সময় মজিদ কাজী নিয়ে আসে। এবং আশে পাশের বাসার মুরুব্বীদের নিয়ে মর্জিনা এবং নজরুলের বিয়ে দেয়। মর্জিনা কেঁদে ফেলে। মা, বাবা এবং বড় ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে। যদি মা, বাবা থাকতো ভালোই হতো।
নজরুলেরও খুব ইচ্ছা হচ্ছিল যদি মা বিয়েতে থাকতো। মানুষের খুব ইচ্ছা ছিল নজরুলের জন্য একটি লাল টুকটুকে বউ আনবে। নিজের হাতে বউয়ের মাথায় তেল দিয়ে দিবে। কিন্তু সেটা আর হলো না।
বাসর রাতটা বেশ ভালোই কেটেছে। সকাল বেলা ফ্রেশ হয়ে মর্জিনা গ্যাসের চুলায় ভাত এবং ডিম ভাজি করে। মর্জিনা তেমন রান্না করতে পারে না। কারণ মর্জিনা কখনোই রান্না করে যায়নি। শুধু শখ করে ডিম ভাজি করা শিখেছিল।
দুজনে ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খায়। এই প্রথম মর্জিনা একা ভাত খাচ্ছে সেটাও শুধু ডিম ভাজি দিয়ে। নজরুল ভাত খাওয়া শেষ করে শিমুলতলী আসে। এখানে মজিদ আনোয়ারের দোকানে বসে থাকে। নজরুল, মজিদের সাথে চাকুরীর ব্যাপারে কথা বলে। মজিদ বলে, দুই তিনদিনের মধ্যে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
নজরুল বাসায় ফিরে আসে। মর্জিনা রুমের ভিতর বসে কাঁদছিল। মর্জিনাকে কাঁদতে দেখে নজরুল বলে, এভাবে কাঁদবে না বলে দিলাম। তুমি কাঁদলে তোমার সাথে আমিও কাঁন্না করবো। নজরুল মর্জিনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেয়। মর্জিনাও দুহাতে নজরুলকে বুকের সাথে জাপটে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে।
চলবে...
মতামত দিন