ভাইয়া আপনে
একা মালা বিশ ট্যাকা দিয়া কিনলে আমি দুপুরে প্যাট ভইরা ভাত খাইতে পারমু। নেননা
ভাইয়া একটা মালা।
পিচ্চি
মেয়েটার কথা শুনে আমার ঠিক কলিজায় আঘাত লাগলো। আমি বিশ টাকায় ফুলের মালা কিনলে ও
দুপুরে পেট ভরে খেতে পারবে?
তোমার ফুলের
মালা আমি নিতে পারি। তবে একটা শর্ত আছে।
শর্তের কথা
শুনে ফুল বিক্রেতা মেয়েটি সাদা মেঘের মতো হাসি হেসে বললো,কি শর্ত ভাইয়া?
আমার সাথে আধা
ঘন্টা গল্প করতে হবে। তাহলেইআমি তোমার সব মালা কিনে নিবো।
আমার কথা শেষ
হতেই পিচ্চি মেয়েটির চোখে অশ্রুর অভাস পেলাম। মনে হচ্ছে মেয়েটি খুশিতে কেঁদে ফেলবে।
শুধু কষ্টের চোটে চোখে অশ্রু ঝরে না। কখনো কখনো আনন্দের সময়ও চোখে অশ্রু আসে।
হুঁ ভাইয়া আমি
রাজী আছি। তো বেশি দেরি করবার পারুম না। যদি দেরি কইরা মায়ের কাছে যাই তাই মা ধইরা
মারবো।
দেরি করাবো
না। জাষ্ট আধা ঘন্টা তোমার সাথে গল্প করবো।
তোমার কাছে
কয়টি মালা আছে দাও তো?
পিচ্চি
মেয়েটির হাতে যতো মালা ছিল সবগুলো আমাকে দিয়ে বললো, ভাইয়া আমি বেশি গুনবার পারি না। আপনে হিসাব কইরা নেন।
বলো কী?গুনতে না পারলে তো মানুষ তোমাকে
ঠকিয়ে মালা নিবে।
হ ভাইয়া কাইল
এক ভাইয়া আমার থিকা পাঁচা মালা নিয়া আমারে পঞ্চাশট্যাকা দিয়া গেছে গা। পাঁচটা মালার দাম একশো ট্যাকা
হয়। সে আমারে অনেক গুলান ভাংতি ট্যাকা হাতে দিয়া কইলো এইহানে একশো ট্যাকা আছে। আমি
তো ইশকুলে যাই নাই হিসাবও বুঝি না। ভাইয়ার কথা মাইনা লইছি। পরে মায়ের কাছে গেছি মা
কয়সে আমারে ঠকাইছে।
তুমি স্কুলে
যাও না কেন?
ভাইয়া আমরা
গরীব মানুষ আমাগো আবার ইশকুল আছেনি?
আমি ইশকুলে
পড়তে গেলে ফুল বেচবো কেডা?ফুল না বেচতে পারলে চাল কেনা হইবো না খাওয়া হইবো না। হের
লাইগা ইশকুলে যাই না।
তোমার নাম কী?
মা আমারে পরী
কইয়া ডাকে।
ওয়াও সুন্দর
নাম তো। আসলেই তুমি পরীর মতো।
তোমরা কয়
ভাইবোন?
আমরা দুই
ভাইবোন। আমার ছোডো ভাই মায়ের লগে থাহে। আর আমি ফুল বেচি।
এতো বকুল ফুল
কোথায় পাও?
এই পার্কেই
অনেক বকুল ফুলের গাছ আছে। আমার মা ফুল টোকায়া মালা গাইথা আমারে দেয় আমি সারাদিন
পার্কে ঘুরি আর মালা বেচি।
সারাদিনে কত
টাকার মালা বিক্রি করো?
ভাইয়া আমি
হিসাব বুঝি না। তো মা মাঝে মদ্দে কয় দুইশো, তিনশো ট্যাকা।
প্রতিদিন
এভাবেই মালা বিক্রি করো?
হ ভাইয়া।
মানুষের কাছে
গিয়ে মালা বিক্রি করতে তোর ভয় করে না?
যেইহানে
ম্যালা মানুষ থাহে ঐ হানে যাই না। যদি ওরা আমার মালা কাইড়া নেয়। দুই, একজন থাকলে গিয়া বলি ভাইয়া মালা নেন।
শুধু ছেলেদের
কাছে মালা বিক্রি করো? নাকি মেয়েদের
কাছেও?
আপুরা মালা
কিনবার চায় না। ভাইয়ার মালা কিন্না আপুগো দেয়। তাই আপুগো কাছে যাই না।
তোমার
লেখাপড়া করতে ইচ্ছা করে না?
ভাইয়া আমরা
হইলাম গরীব মানুষ ফুল বেইচা খাই। আমি কেমন পড়ালেখা করমু?আমি ইশকুলে গেলে আমাগো হগলের না খায়া থাকোন লাগবো।
তোমার বয়স
কতো?
বয়সের কথা
পিচ্চি পরী হাসতে লাগলো। মনে হচ্ছে এই পার্কটিতে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
কি হলো হাসছো
কেন? বলো তোমার বয়স কত?
জানিনা ভাইয়া।
তোমার বয়স কত
সেটাও জানো না?
না ভাইয়া।
পরী নিজের
বয়স কত সেটাও জানে না। আর জানারও কথা নয়। যে বয়সে পরীর স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে পরী সংসারের হাল ধরেছে। মায়ের কুড়িয়ে আনা
ফুল থেকে মালাতৈরী করে
বিক্রি করে জীবন যাপন করা।
ভাইয়া আর
কিছু কইবেন? দেরি কইরা
মায়ের কাছে গেলি মায় ধইরা মারবো।
না তোমাকে আর
প্রশ্ন করবোনা। তবে তোমার একটি ছবি তুলবো।
আমার ছবি
তুইলা কি করবেন?
তোমার সাথে
যে এতোক্ষন কথা বললাম তা স্মৃতি হিসেবে রেখে দিতে চাই।
তাইলে আমার
মালার ট্যাকা দেন আর ছবি তুইলা নেন। আমি মায়ের কাছে যামু।
তোমার টাকা
নাও সমস্যা নেই। কিন্তু ছবি এখন তুলতে পারবো না। আমার একজন আসবে সে আসলে তুলবো।
আপনের
বান্ধবী আইবো?
হুম।
ভাইয়া তাইলে
ম্যালা দেরি হইবো তো।
দেরি হবে না।
একটু পরেই আসবে। ততোক্ষনে তুমি আমার সম্পর্কে জানতে চাও।
আমি আপনার
সম্পর্কে কী জানবার চাইমু?
এই যেমন, আমি কি করি, কোথায় থাকি, এই পার্কে কেন এসেছি ইত্যাদি।
আপনের নাম কি
ভাইয়া?
আমার নাম
মাহিন।
একটা প্রশ্ন
করেই পরী চুপ হয়ে গেল। আমি পরীকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হলো আর কিছু জানতে চাইবেনা? পরী জবাব দিলো, না ভাইয়া আমি আর কিছু জানবার চাই না। আমার খুব খিদা লাগছে
আমার ট্যাকা দেন। আমি মায়ের কাছে যামু।
তোমাকে কিছু
কিনে দেই খাবে?
মা কইছে
মানষের দেওয়া কিচ্ছু খাবি না। তাই আমি মানষের দেওয়া কিচ্ছু খাই না।
আচ্ছা ঠিক
আছে খেতে হবে না।
অহন আমার
ট্যাকা দেন আমি যামু গা।
আমি পরীকে
মালার টাকা দিবো। কিন্তু আমি যে মানবীর অপেক্ষায় বসে আছি সেই মানবীর আসার নামগন্ধ
নেই। জানিনা সেই মহামানবী কখন আসবে?
পরী আজকে
তোমাকে গুনতে শেখাবো যাতে কেউ তোমাকে ঠকাতে না পারে বুঝেছো?
হ বুঝছি।
এই নাও তোমার
মালা। একটি একটি করে আমার হাতে দিবে আর আমি যা বলব তাই বলবে। ঠিক আছে?
পরী মাথা
নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।
পরী আমার
হাতে মালা দেয়এক, দুই,
তিন, চার,
পাঁচ, ছয়,
সাত, আট,
নয়, দশ,
এগার, বারো, তেরো,
চৌদ্দ, পনেরো।
আমি পকেট
থেকে একটিপাঁচশো টাকার
নোট বের করে পরীর হাতে ধরিয়ে দেই।
পরী টাকা
পেয়ে খুব খুশি। হয়তো পরীর কাছে মনে হচ্ছে আজকে ওর ঈদের দিন। সবগুলো মালা একজন কিনে
নিয়েছে। এই মালা গুলো বিক্রি করতে পরীর সারাদিন লাগতো অথবা চার, পাঁচ ঘন্টা লাগতো।
পরী টাকা
পাওয়ার পরও আমার পাশে বসে আছে।
কি হলো পরী
তোমার মায়ের কাছে যাবেনা?
হ যামু। আপনে
না কইলেন আমার ছবি তুলবেন।
হুম তুলতে তো
চেয়েছিলাম কিন্তু আমার মানুষটা তো এখনো আসছেনা।
আপনে কি তারে
ভালোবাসেন?
হুম অনেক
ভালোবাসি।
ওহ, তাইলে আইবো না।
তুমি কিভাবে
বুঝলে আসবেনা?
যারে বেশি
ভালোবাসুন যায় হেই জীবন থিকা চইলা যায়। ঠিক আমার আব্বার মতো।
পরী তোমার
বুঝলাম না?
আমার মা
আব্বারে খুব ভালোবাসতো। আব্বার অসুখ হইছিল তহন মা মানষের বাড়িত্তে কাম কইরা ট্যাকা
আইনা আব্বারে ওষুধ খাওয়াইছে। হেই আব্বু অসুখে থিকা উঠোনের পর এক বিয়াত্তা বেডির
লগে ভাইগা গেছে। হের পর থিকা মা বাড়িত যায় না। আমারে আর আমার ছোডো ভাইরে নিয়া এই
পার্কের শ্যাষ মাথায় খুপড়ির লাহান ঘর বানায়া থাহে।
পরীর মুখে এই
কথা শুনে আমি অবাক হলাম। আমার পুরো পৃথিবী থমকে গেল। শুরু হয়ে গেল বুকের ভিতর
ধুকধুক।
অবশেষে কি
পরীর কথা সত্যি হবে? আমি যে
মানবীর জন্য অপেক্ষা করছি সেই মানবী আমাকে ধোঁকা দিবে?
তোমার
আব্বাকে দেখতে ইচ্ছা হয় না?
খুব ইচ্ছা হয়।
কিন্তু আব্বা তো এইহানে থাহে না।
পরী আর
কিছুক্ষন থাকলে হয়তো আমি কাঁদতে বাধ্য হবো তাই পরীকে বললাম, তোমার না ক্ষুধা লেগেছে? তুমি চলে যাও।
ভালা থাকবেন
ভাইয়া।
এই বলে পরী
চলে গেল।
পার্কে জোড়ায়
জোড়ায় ভালোবাসার মানুষগুলো হাটতে। শুধু আমি একলা বসে আছি নাম না জানা একটি গাছের নিচে।
আমার হাতে পনেরোটি বকুল ফুলের মালা। আজকে ফাতেমাকে চমকে দিতে চাই। বলে দিতে কতটা
ভালোবাসি। পনেরোটি মালাতে যতো ফুল আছে ঠিক ততো বছর দুজনে স্বামী, স্ত্রী হয়েথাকতে চাই এই সুন্দর পৃথিবী।
দেখিয়ে দিতে
চাই ভালোবাসলে সব করা সম্ভব।
দুপুর গড়িয়ে
বিকেল হতে চললো। কিন্তু ফাতেমার আসার খবর নেই। আমার খুব চিন্তা হইছিল রাস্তায় কোনো
বিপদ হয়নি তো?
ফাতেমা
বলেছিল ওকে যেন কল না করি। তাই কলও করতে পারছিনা। এযাবৎ ত্রিশটির মতো ম্যাসেজ
পাঠিয়েছি ওপাশ থেকে রিল্পে আসেনি। বুকের ভিতর ধুকধুক করেই চলছে।
হঠাৎ মোবাইল
টুং করে উঠলো। খুশিতে আমার মন ভরে গেল।
মোবাইলের লক
খুলে দেখি, স্যরি মাহিন। তুমি আমাকে ভুলে
যাও। আর আমার নাম্বারে কল দেওয়ার চেষ্টা করো না। ভালো থেকো। বাই।
স্কুলে না
যাওয়া পরীও জেনে গেছে কাউকে বেশি ভালোবাসতে নেই। বেশি ভালোবাসলে কষ্ট পেতে হয়। ঠিক
পরীর মতো। বাবা থাকার পরও সংসারের দায়িত্ব ছোট্ট পরীর হাতে। পনেরোটি মালা কেনার
বদলে পরী আমাকে শিক্ষা দিয়ে গেল অতিরিক্ত ভালোবাসা ঠিক না। পরী আমার ভালোবাসার
মানুষটাকে না দেখে, নাম না জেনেই
এক বাক্যে বলে দিয়েছে সে আসবেনা। অথচ দীর্ঘ তিন বছরেও আমি ভালোবাসার মানুষটাকে
চিনতে পারিনি।
পরীর জীবন
পরীর মায়াবী মুখের মতোই উজ্জল হোক।
ভালোবাসার
দামে কেনা পনেরোটি বকুল ফুলের মালা আমার আর ফাতেমার ভালোবাসার সাক্ষী হিসেবে এই
পার্কের নাম না জানা গাছের তলেই পড়ে থাক।
মতামত দিন